বৃহঃস্পতিবার, ৯ই অক্টোবর ২০২৫, ২৩শে আশ্বিন ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


দেশে বছরে ৩৪ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয়, রোধ করা কি সম্ভব?


প্রকাশিত:
৮ অক্টোবর ২০২৫ ১১:২১

আপডেট:
৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:৪৪

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে বছরে কৃষকের খামার থেকে শুরু করে ভোক্তার টেবিলে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ টন খাবার নষ্ট ও অপচয় হয়। সিপিডি ‘খাদ্যের অপচয় রোধের মাধ্যমে টেকসই খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এই তথ্য জানান।

খামার থেকে বাজার, রান্নাঘর, খাবার টেবিল, প্রতিটি ধাপে খাদ্য নষ্ট হচ্ছে কিন্তু এখনো সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। বাংলাদেশে ফল ও সবজিতে ৩২ শতাংশ, ছোট মাছে ২৫ শতাংশ এবং ধান-গমে ১৭ শতাংশের বেশি পরবর্তী ধাপে ক্ষয় হয়ে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্বল সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এ সমস্যাকে আরও তীব্র করছে। স্মার্টভাবে খাদ্য সংরক্ষণ, বাজারে প্রবেশাধিকার, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং উন্নত তথ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে আরও কার্যকর, জলবায়ুবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে:

‘শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে’ বলতে বোঝানো হয় এমন একটি লক্ষ্য বা প্রচেষ্টা, যেখানে সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্যের অপচয় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ বা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্যর ২৭ শতাংশই খাবার টেবিলে আসে না।

সংরক্ষণে ঘাটতি, হিমাগারের স্বল্পতা ও পরিবহনজনিত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এ কারণে বড় ধরনের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বাংলাদেশকে। মোট আবাদ হওয়া জমির মধ্যে ২৭ শতাংশ বা ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটারে উৎপাদিত খাদ্য শেষ পর্যন্ত অপচয় হচ্ছে প্রতি বছরে।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য অপচয় ও ক্ষতি রোধ করতে হবে। একদিকে অনেক মানুষ খাদ্যের অভাবে অনাহারে থাকছে, অন্যদিকে উৎপাদিত বিপুল খাদ্যের একটি বড় অংশ অপচয় হচ্ছে- যা দুঃখজনক।

বাংলাদেশে খাদ্যের অপচয়:

২০২৫ সালের বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশে বছরে ৩৪ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয়! অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার পায় না। অব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা ও পরিবহনজনিত কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্য পণ্যর মধ্যে গড়ে ৩৪ শতাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য আরও বলছে, নষ্ট বা অপচয় হওয়া এই খাদ্যপণ্যের আর্থিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশ।

অন্যদিকে কয়েকটি ফসলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে World Bank / Bangladesh Food Loss & Waste Diagnostic & FAO-এর রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর ২৩ শতাংশ চাল, ২৭ শতাংশ মসুর ডাল, ৩৬ শতাংশ মাছ এবং ২৯ শতাংশ আম নষ্ট বা অপচয় হয়। এছাড়া ধানের ২৩-২৮ শতাংশ, ফসল কাটার পরে গমের সাড়ে ১৭ শতাংশ, উদ্যানজাত ফসলের মধ্যে কলার ২০ শতাংশ, আলুর ২২ শতাংশ, গাজরের ২৭ শতাংশ, টমেটোর ১০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে।

ব্যক্তি পর্যায়ে খাবার গ্রহণের সময়ে বাংলাদেশে একজন বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাবার নষ্ট করে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেপের ২০২২ সালের প্রতিবেদন এই তথ্য দিচ্ছে। খাবার নষ্ট করার এ হার যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও জাপানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বেশিরভাগ খাদ্য অপচয় হয় উৎপাদন, পরিবহন, পরিচালনা, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং খাবার সময়ে।

কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে অপচয়:

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ১৯৯৬ সাল থেকে খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেছে। তখন খাদ্য প্রাপ্ততা বড় বিষয় ছিল। এখন খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে পুষ্টিও যুক্ত হয়েছে। দেশে বর্তমানে মাছের উৎপাদন প্রাকৃতিক উৎস থেকে ৬০ শতাংশ ও চাষ থেকে ৪০ শতাংশ আসতো বর্তমানে চাষ থেকে আসছে ৬০ শতাংশ ও প্রাকৃতিক উৎস থেকে ৪০ শতাংশ। তাই প্রাকৃতিক মাছ নষ্ট হওয়া প্রতিরোধে কাজ করতে হবে।

কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের পণ্য পচনশীল হওয়ায় সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ফলে দুধ, ডিম, মাছ ও মাংসসহ নানা খাদ্যপণ্য অপচয়ের শিকার হচ্ছে।

সামুদ্রিক মৎস্য খাতে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ জাল ব্যবহার, লক্ষ্যভিত্তিক মাছ ধরা এবং অপ্রচলিত প্রজাতি বাজারজাতের অভাবে বিপুল পরিমাণ মাছ ফেলে দিতে হচ্ছে। মাছের বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে; একসময় ২৬৭ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত, এখন তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য অপচয় ও ক্ষতি উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি সুরক্ষা ও জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ:

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও, এখনো অপুষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে, বিশেষত নারীদের মধ্যে এই সমস্যা প্রকট। দেশে উৎপাদিত খাদ্যের একটি বড় অংশ এখনো অপচয়ের শিকার হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার পথে বড় বাধা।

মাছের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপচয় হয়। অনেক সময় জেলেরা মাছ ধরার পর দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত মাছ ফেলে দেন, মাছগুলো হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে অথবা কাঙ্ক্ষিত জাতের নয়। এসব ফেলে দেওয়া মাছের বেশিরভাগই মারা যায়, ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মূল্যবান সম্পদ যেমন মাটি, পানি, শ্রম এবং অর্থের অপচয় ঘটে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়, যা দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি খাদ্য সংকট তৈরি করে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। এই বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের জন্য এমন এক বিশাল ভূমি ব্যবহার করা হয়, যার আয়তন চীনের মতো দেশের চেয়েও বড়, তবুও সেই খাদ্য শেষ পর্যন্ত মানুষের পেটে পৌঁছায় না।

বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত খাদ্য বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড়গুণেরও বেশি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অসম বণ্টন, দুর্বল অবকাঠামো এবং সর্বোপরি খাদ্য অপচয়ের কারণে এখনো অনেক মানুষ অপুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও এই অপচয়ের কারণেই সবচেয়ে দরিদ্র ও প্রয়োজনীয় মানুষের কাছে তা পৌঁছায় না। তাই, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে খাদ্যের অপচয় রোধ করা এখন সময়ের দাবি।

গবেষণার তথ্য:

World Food Programme এবং Food and Agriculture Organization এর গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ফসল তোলার পর ৮-১৫ শতাংশ চাল এবং ২০-৪০ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ সবজি, মাছ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎপাদনে একটি শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও, অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং কোল্ড চেইনের অভাবে সেই পণ্যগুলোই আমদানি করতে হয়। এটি কৃষক এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্যই একটি সুযোগের অপচয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যদি আমরা খাদ্য অপচয় বাড়াই, তাহলে আমরা দুর্লভ পরিবেশগত সম্পদ নিঃশেষ করছি। তাই আমাদের জন্য খাদ্য অপচয় কমানো অপরিহার্য।

দেশে খাদ্য অপচয় মোকাবিলা:

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের সাথে এই নীরব সংকট মোকাবিলায় বাস্তব সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এফএও (FAO) বাজার থেকে শুরু করে খামারে খাদ্যের ক্ষতি মোকাবিলা করছে, তাজা সবজি বা ফলের বাজারে বিক্রেতাদের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ্য পৃথকীকরণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং জৈব বর্জ্যকে পশুখাদ্যে রূপান্তর করার জন্য ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই টেকনোলজি চালু করছে। মৎস্যক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াতে শুঁটকি শুকানোর পদ্ধতি ক্ষতি কমাচ্ছে এবং গুণমান উন্নত করছে।

এফএও বাংলাদেশ আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ, সৌরশক্তিচালিত কুলিং ইউনিট এবং কৃষক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করে ফসল কাটার পরের ক্ষতি কমাচ্ছে। ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণ, আয় বৃদ্ধি এবং খাদ্য অপচয় কমাতে সাহায্য করছে।

স্মার্ট স্টোরেজ এবং হ্যান্ডলিং এর মাধ্যমে, খাদ্য মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং রপ্তানি মান পূরণ করছে, বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য নতুন দরজা খুলে দিচ্ছে। এখানেই থেমে নেই, বিষাক্ত বালাইনাশকের পাত্রের নিরাপদ নিষ্কাশন থেকে শুরু করে ‘এক দেশ এক অগ্রাধিকার পণ্য’ উদ্যোগকে (যেমন কাঁঠাল) এগিয়ে নেওয়া, সব ক্ষেত্রে এফএও খাদ্য অপচয় কমাতে এবং একটি উন্নত জীবন এবং ন্যায্য খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে।

খাবার টেবিলে খাদ্য অপচয়:

খাদ্য অপচয় আমাদের সমাজে একটি গুরুতর সমস্যা, যা অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর। খাবার টেবিলে অপ্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ, অব্যবহৃত অংশ ফেলে দেওয়া বা সচেতনতার অভাব এর অন্যতম কারণ। এই অপচয় রোধে প্রয়োজন সচেতনতা, পরিকল্পিত খাদ্য গ্রহণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ।

পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে অপচয় রোধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণই হতে পারে একটি টেকসই ভবিষ্যতের প্রথম ধাপ। খাদ্য অপচয় রোধে সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

সমীরণ বিশ্বাস : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top