বৃহঃস্পতিবার, ৯ই অক্টোবর ২০২৫, ২৩শে আশ্বিন ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে, আসন্ন বিপদ ঠেকাবে কে?


প্রকাশিত:
৭ অক্টোবর ২০২৫ ১০:৪৯

আপডেট:
৭ অক্টোবর ২০২৫ ১০:৫৩

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ডেঙ্গু আজ আর নতুন কোনো রোগ নয়, বরং এক গভীর সংকটের নাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটি মৌসুমী সীমাবদ্ধতা ভেঙে সারা বছরব্যাপী আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। তবে বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৪৯ হাজার ৯০৭ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রাণ হারিয়েছে ২১২ জন। কেবল সেপ্টেম্বর মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৮৬৬ জনে। এর সঙ্গে আমাদের গবেষণা তথ্য যুক্ত করলে স্পষ্ট হয় যে, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, কারণ এডিস মশার ঘনত্ব এখন ডেঙ্গু বিস্তারের উপযোগী মাত্রায় রয়েছে।

রাজধানী ঢাকা এ রোগের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় সর্বাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে সংক্রমণ কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নয়। চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেটসহ প্রায় সব বিভাগেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে।

এমনকি গ্রামীণ এলাকাও আর নিরাপদ নেই। আগে ডেঙ্গু মূলত শহরমুখী রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু এখন তা উপজেলা পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছে। বিশ্লেষণ বলছে, আক্রান্তদের দুই-তৃতীয়াংশ নগরবাসী হলেও গ্রামীণ এলাকায়ও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলবে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বাধিক। এর মানে দাঁড়ায় দেশের শিক্ষার্থী ও কর্মশক্তিই সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এতে একদিকে পরিবারগুলো অকাল শোকের মুখোমুখি হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষা ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি বাড়ছে এবং প্রতিটি পরিবারে চিকিৎসা ব্যয় বহনের চাপ বেড়েই চলেছে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ বোঝার ক্ষেত্রে শুধু রোগীর সংখ্যা নয়, এডিস মশার ঘনত্বের তথ্যও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গবেষণা বলছে, বর্ষার কারণে লার্ভাযুক্ত পানির পাত্রের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে। বাড়ির ভেতর-বাইরে ছোট ছোট পাত্র, ফুলের টব, প্লাস্টিকের বোতল, নির্মাণাধীন ভবনের জমে থাকা পানি কিংবা ড্রামের মতো উৎসে লার্ভার বিস্তার ঘটছে।

শুধু তাই নয়, প্রতি কনটেইনারে লার্ভার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ একেকটি উৎস থেকেই এখন বহুগুণ মশা উৎপাদিত হচ্ছে। উচ্চ ঘনত্ব মানেই সংক্রমণের গতি বহুগুণ বাড়বে। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে অক্টোবরে রোগীর সংখ্যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিগুণ বা ততোধিক হতে পারে।

প্রশ্ন উঠছে; আমরা কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছি?

প্রথমত, মশক নিধন কার্যক্রম কার্যকর নয়। সিটি কর্পোরেশন প্রায়শই কাগুজে পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবে তেমন ফল পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার অভাব প্রকট।

দ্বিতীয়ত, জনসচেতনতা এখনও পর্যাপ্ত নয়। বহু পরিবারই পানি জমে থাকা প্রতিরোধে সতর্ক নয়। ফুলের টব, ড্রাম, কলস কিংবা নির্মাণাধীন ভবনে জমা পানি থেকে এডিস মশা অবাধে জন্ম নিচ্ছে।

তৃতীয়ত, সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনগণের মধ্যে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সমন্বয় অনুপস্থিত।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাও ডেঙ্গু মোকাবিলাকে ব্যাহত করছে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রতিদিন নতুন রোগীর চাপ বাড়ছে, কিন্তু শয্যা ও চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা সীমিত। পর্যাপ্ত রক্ত, প্লাজমা বা প্লাটিলেট না থাকলে চিকিৎসা জটিল হয়ে ওঠে। ফলে সাধারণ মানুষ প্রায়শই বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছে, যেখানে খরচ বহন করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।

এ সংকট কেবল স্বাস্থ্যক্ষেত্রেই নয়, অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পরিবারের একজন সদস্য আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয় ও কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে পুরো পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, কর্মঘণ্টার ক্ষতি ও চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অতএব, এখনই জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। মশক নিধন কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিতভাবে চালাতে হবে। লার্ভার উৎস ধ্বংস ছাড়া এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

গবেষণায় প্রাপ্ত প্রযুক্তি যেমন অটো-ডিসেমিনেশন ট্র্যাপ বা জৈব নিয়ন্ত্রণ দ্রুত মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার করা জরুরি। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজে লাগাতে হবে। প্রত্যেক পরিবারকে বুঝতে হবে, এডিস মশার জন্মস্থল ধ্বংস করা তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বও বটে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও জরুরি প্রস্তুতি বাড়াতে হবে। বাড়তি শয্যা, পর্যাপ্ত ওষুধ, রক্ত ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, যাতে রোগীরা অযথা ঢাকায় ভিড় না জমায়।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ডেঙ্গুকে শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা যাবে না। এটি এখন একটি জাতীয় সংকট। এ সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, পরিবেশ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও জনগণ, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সময় এসেছে দায়সারা মনোভাব বাদ দিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের।

অক্টোবর আমাদের জন্য এক পরীক্ষার মাস হতে যাচ্ছে। আজ আমরা যদি দৃঢ় ব্যবস্থা না নেই, তবে অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হবে। তাই এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, না হয় কাল হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার : কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top