শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

Rupali Bank


ক্রসফায়ার ও পাবলিক সেন্টিমেন্ট


প্রকাশিত:
১৩ আগস্ট ২০২০ ০১:৩৯

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২০

প্রতীকী ছবি

আমার সাংবাদিকতার শুরুর দিকের কথা বলছি। সেই সময়েও ঢাকা শহরে প্রত্যেক এলাকা বা পাড়াভিত্তিক বিখ্যাত/কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছিল। মানুষ তাদের হাত থেকে সত্যি সত্যি রেহাই পেতে চাইতো।

এলিট ফোর্স র‍্যাব এসে তাদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশনে গেলো। আমাদের তখন সপ্তাহে একদিন নাইট ডিউটি করতে হতো। আমরা জানতাম, অন্য কোন চ্যানেলে কার ডিউটি আছে। রাতে কোন ঘটনা ঘটলে খবরের আদানপ্রদানও করতাম আমরা। কোন রাতে যদি কিছু নাও ঘটতো তবু শেষ রাতের দিকে সতর্ক থাকতে হতো আমাদের। কারণ, ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো তখনই ঘটতো।

সকাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর খবরের শিরোনাম থাকতো ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা। এসব ঘটনায় অনেকদিন পর্যন্ত মানুষ উল্লসিত থেকেছে। সত্যিকার অর্থেই মানুষ র‍্যাবকে মানুষ পছন্দ করতে শুরু করে। তবে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের স্ক্রিপ্ট গত এক যুগেও পরিবর্তন হয়নি।

'ক্রসফায়ার' মানে সাধারণভাবে আমি যা বুঝি তা হলো- দুইপক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলার সময় মাঝখানে পড়ে যদি কারো মৃত্যু হয়।

এখন কথা হলো, এই ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে সব সময় যে ভয়ংকর অপরাধীরই মৃত্যু হবে তা নয়। কখনো কখনো মৃত্যুদন্ড পাওয়ার মতো অপরাধী নয় এমন ব্যক্তিও ক্রসফায়ারে নিহত হতে পারে। আবার কখনো কখনো নিরপরাধ ব্যক্তিও এমন হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারে।

ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের প্রথম মৌসুমেও এমন দু'একটি ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। সেই সময়টাতে সোচ্চার হলো মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তার আগ পর্যন্ত পুরনো স্ক্রিপ্টেই সংবাদ পরিবেশন করতো গণমাধ্যমগুলো। কিন্তু ক্রসফায়ার আর মানবাধিকার যখন মুখোমুখি অবস্থান নিলো তখন এসব ঘটনার নতুন পরিচয় হলো 'কথিত বন্দুকযুদ্ধ' হিসেবে। এভাবে মিডিয়া একটা গা বাঁচানোর অবস্থানে চলে গেলো।

আর সাধারণ মানুষ করলো কি? সাধারণ মানুষও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে ক্রসফায়ারের বিপরীতে অবস্থান নিতে শুরু করলো। এভাবে নন্দিত থেকে ধীরে ধীরে নিন্দিত হয়ে গেলো ক্রসফায়ার।

কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, ক্রসফায়ারের পক্ষেই জনমত বেশি। এই জনমতই বিচারব্যবস্থাকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে যেখানে পাবলিক সেন্টিমেন্টের পক্ষে বিচার হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বিচারিক প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন হয়নি।

মানুষ কিভাবে ক্রসফায়ারকে সমর্থন করে তার একটা ছোট্ট প্রমাণ দেই।
একের পর এক যখন সারা দেশজুড়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছিল, তখন 'হারকিউলিস' নামে এক অদৃশ্য চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। অভিযুক্ত ধর্ষণকারীর মৃতদেহের পাশে হারকিউলিসের চিরকুট থাকতো। এটাতে মানুষ উল্লসিত হতো। তারপরের কোন ঘর্ষণের ঘটনা ঘটলে, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতো 'হারকিউলিস কোথায়?'

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা বা অবিশ্বাসের কারণেই সমাজে এমন সঙ্কট তৈরি হতে পারে। এমনকি কোন কোন বড় অপরাধের ঘটনা যখন প্রকাশিত হয় তখন মানুষ প্রায়ই মন্তব্য করে, 'ক্রসফায়ারে দেয়া উচিত'।

একেবারে নির্মোহ জায়গায় থেকে বিষয়গুলো ভাবলে দেখবেন পাবলিক সেন্টিমেন্ট এর বাস্তব চিত্র। এবার কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় আসি-

কক্সবাজারের এই ঘটনায় অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি টেকনাফের সদ্যসাবেক ওসি প্রদীপ। এখন জানা যাচ্ছে, দুই শতাধিক ক্রসফায়ারের রেকর্ড আছে তার। মেজর সিনহার ঘটনা না ঘটলে, এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারতো।

এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ওসি প্রদীপের এত অপকর্মের খবর মিডিয়ায় আগে কেন আসেনি? আমার কাছে মনে হয়, এক্ষেত্রেও পাবলিক সেন্টিমেন্ট বড় প্রভাবক ভূমিকা পালন করেছে। কারণ, এ দেশের মানুষ সবাই জানে টেকনাফ হলো এদেশে ইয়াবার সবচেয়ে বড় রুট। এমনকি ইয়াবা ব্যবসা করে টেকনাফে অনেক রাঘব বোয়াল তৈরি হয়েছে।

টেকনাফ সম্পর্কে এমনই পাবলিক সেন্টিমেন্ট। ঘটনা আবার মিথ্যাও নয়। সুতরাং এমন জায়গায় নিয়মিত বন্দুকযুদ্ধ হবে এবং মাদক ব্যবসায়ী নিহত হবে এটাকেই স্বাভাবিক ভেবেছে মানুষ বা গণমাধ্যম। এভাবেই ওসি প্রদীপের প্রোফাইলে দুই শতাধিক ক্রসফায়ারের পালক যোগ হয়েছে। শুধুমাত্র মেজর সিনহার ঘটনায় পাবলিক সেন্টিমেন্ট তার বিরুদ্ধে চলে গেলো। না হলে বলা যায় না, দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে রাফ-টাফ অফিসার হিসেবে ওসি প্রদীপের নাম সবার উপরে থাকতো।

ধারণা করছি, মেজর সিনহার হত্যাকান্ডের পর ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা বিনা বিচারে হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি প্রত্যাশা করি, আইন ও বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যেই সব অপরাধ নির্মুল হোক।

কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে একটু আগাম বলে রাখি-
মেজর সিনহার ঘটনা পুরনো হতে থাকবে। নতুন নতুন ঘটনায় বুদ হয়ে যাবো আমরা। এবং ক্রসফায়ার যদি বন্ধ হয়....
তাহলে আগামী ১ মাসের মধ্যে কোন না কোন বড় ঘটনায় আবার নিজের অজান্তেই মানুষ লিখবে- 'ক্রসফায়ার চাই'

আগামী কমপক্ষে ১০০ বছর পর্যন্ত এ দেশে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বাতাসের গতি প্রকৃতির সাথে সাথে বদলাবে।

মুনজুরুল করিম
গণমাধ্যমকর্মী
ঢাকা, ০৮ আগস্ট ২০২০



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top