রবিবার, ২৭শে জুলাই ২০২৫, ১২ই শ্রাবণ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


ট্রাম্পের শুল্কঝড় ও বাংলাদেশের অবস্থান


প্রকাশিত:
২৪ জুলাই ২০২৫ ১০:৫৭

আপডেট:
২৭ জুলাই ২০২৫ ১৩:৩৮

ছবি সংগৃহীত

২ এপ্রিল ২০২৫ ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন শুল্কনীতিতে সারা বিশ্ব থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক ধার্য করেন, যা বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের আলোকে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্কারোপ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তি তাদের আরোপিত নতুন শুল্কহার অন্য সময়ের চেয়ে অধিক হলেও তা মার্কিন পণ্যের ওপর বিভিন্ন দেশ কর্তৃক আরোপিত শুল্কহারের চেয়ে কম। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটা বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়।

এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর ওপরও এই শুল্কহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও তা অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় কম, যা থেকে যে বিষয়টি বিষয় সামনে চলে আসে তা হচ্ছে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ট্রাম্পের এই নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে একে ৩ মাসের জন্য স্থগিত করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে এই বিষয়ে দরকষাকষির একটি নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়, যা ৯ এপ্রিল ২০২৫ উত্তীর্ণ হয়েছে এবং এদিন বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের জন্য তাদের সংশোধিত শুল্কনীতি প্রকাশ করা হয়।

এই শুল্কনীতিতে পূর্বের, অর্থাৎ এপ্রিল মাসে আরোপিত শুল্কের চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করে তা ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, এর আগে যা ছিল ১৫ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে এক্ষেত্রে ৩ মাস সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একাধিকবার আলোচনা এবং দেনদরবার করার পরও আমরা খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য জানিয়েছে যে আলোচনার দরজা এখনো খোলা আছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে এই শুল্কহার হ্রাসের বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য। সঙ্গত কারণেই মার্কিন নতুন শুল্কহার আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক আয়ের খাত তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তৈরি পোশাকের বাইরেও বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য, টেক্সটাইল, সিরামিক, হিমায়িত পণ্য, চিংড়ি, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে আসছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ বর্ধিত আয় হয়েছে, তা ৫৪টি দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সমান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতকে কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এই সময়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো, যারা তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেগুলো হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি।

সম্প্রতি তাদের সংশোধিত শুল্কহার থেকে দেখা যায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মালয়েশিয়ার ওপর থেকে পাল্টা শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস হয়ে তা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। অপরাপর দেশগুলো এখনো আলোচনা চালিয়ে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে চীনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র মূলত তাদের এই পাল্টা শুল্কনীতি প্রণয়ন করেছে, সেই চীনের সাথে তাদের সাম্প্রতিক আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং উভয়পক্ষই কিছু ছাড় দিয়ে একে অপরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালিয়ে নিতে অনেকটাই একমত হয়েছে। তবে তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এখানে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উল্লেখ করতে হয় তা হচ্ছে যে, নতুন শুল্কহার ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তা এতদিন ধরে চলমান শুল্কের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে আরোপ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা এই আলোচনায় অনেক দেশের ওপর থেকে এই হার কমালেও তা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়নি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কথা যদি ধরি তাহলে এতদিন ধরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আসছিল।

নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্কহার, যা ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এমনটা হলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য হবে যুক্তরাষ্ট্রে। এই সময়ের মধ্যে আলোচনা প্রক্রিয়া যদি সফল হয়, তাহলেও এই অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা থেকে পুরোপুরি মুক্তি মিলছে না, সেটা অবশ্য সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য।

এক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসায়ী তথা রপ্তানিকারকদের দুশ্চিন্তা বাড়লেও এবং আমাদের উৎপাদিত তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও আমাদের একটু ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে যে আমরা কার্যত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এটি বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আমাদের উৎপাদিত পণ্য, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে, এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ কোনগুলো এবং তাদের ওপর দিনশেষে কতটা শুল্ক ধার্য করা হবে।

এক্ষেত্রে আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের পণ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর ক্ষেত্রে শুল্কহার আমাদের চেয়ে কম হয়েছে এমনটা দেখিনি, যদিও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তা ২৫ শতাংশ। এখানে এটাও উল্লেখ করতে হয় যে ভিয়েতনামের উৎপাদন খরচ আমাদের চেয়ে বেশি হওয়ায় সেক্ষেত্রে শুল্কহার কম হলেও যখন একই ধরনের পণ্য বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করবে, ক্রেতা চাহিদায় এবং দামে আমাদের পিছিয়ে থাকার সম্ভাবনা সেক্ষেত্রে কম থাকবে।

শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। সুতরাং দুশ্চিন্তা থাকলেও এক্ষেত্রে একধরনের নতুন প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো অবস্থায় থাকতে হবে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৮৭৬ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০৯ কোটি ডলার বা ১৪ শতাংশ বেশি। এই ৮৭৬ কোটি ডলারের মধ্যে কেবল তৈরি পোশাক রপ্তানি বাবদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আয় হয়েছে ৭৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির উপর অতি নির্ভরশীল, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে আমরা বিকল্প কোনো গন্তব্য থেকে এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করার পথ দেখি না। অবশ্য এখানে আরেকটা বড় হুমকি হচ্ছে, যখন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে, ভোক্তাদের এই অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে, সেক্ষেত্রে এতদিন ধরে তুলনামূলক সস্তা পণ্য আর সস্তা থাকছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রির অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, সে দেশের সরকারের অতিরিক্ত শুল্কের কারণে বাড়তি উপার্জনের পথ যেমন তৈরি হবে, স্থানীয় উৎপাদন খাতগুলোয় প্রাণের সঞ্চার ঘটতে পারে। এটা ট্রাম্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এই উদ্দেশ্যের পাশাপাশি আলোচনার পথ খোলা রেখে তারা মূলত চীনের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা যেমন করছে, একইভাবে তাদের উৎপাদিত পণ্য কম শুল্কে বা বিনাশুল্কে অপরাপর দেশগুলোয় প্রবেশাধিকারের একটা উপায় অন্বেষণ করতে চাইছে।

বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সরকারের জন্য দরকষাকষির কিছু সুযোগ রেখেছে। ২০১৩ সালে যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছিল, সরকারের দিক থেকে যদি সেদেশকে এটা বোঝাতে পারা যায় যে, সেই অবস্থা এখন আর বিদ্যমান নেই, তাহলে এই জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া অতিরিক্ত শুল্কের ধকল থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে।

সেই সাথে আলোচনার গতিকে আরও শক্তিশালী করে বিদ্যমান শুল্ক যদি আরেকটু কমিয়ে আনা যায়, তাহলে অপরাপর দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের মতো পণ্য উৎপাদনকারী কোনো দেশকেই শুল্ক ছাড় না দেয় এবং এর হ্রাস যদি আমাদের চেয়ে খুব বেশি না হয় বা এর হার যদি সমান থাকে, তাহলে আমাদের একার জন্য চিন্তার খুব একটা কারণ নেই।

ড. ফরিদুল আলম : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এসএন /সীমা


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top