ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে, প্রস্তুতি কি বাড়ছে?
প্রকাশিত:
১ জুলাই ২০২৫ ১১:০২
আপডেট:
১ জুলাই ২০২৫ ১৮:০৩

বাংলাদেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয় এবং এরপর থেকে প্রতি বছরই কিছু না কিছু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে ২০২৩ সালে এই রোগ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। চলতি বছরেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং সরকারিভাবে ৪০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।
গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ, কারণ অনেকেই বাসায় বা অনিবন্ধিত ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যাদের তথ্য সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয় না। এই পরিসংখ্যানগুলো এক গভীর সংকটের দিকেই ইঙ্গিত করছে, যা যদি এখনই সমাধানে না আনা যায়, তাহলে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ডেঙ্গু কীভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা Aedes aegypti এবং Aedes albopictus নামক এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশাগুলো সাধারণত সকালে ও বিকেলে কামড়ালেও সারা দিন ও রাতে কামড়াতে পারে। তারা স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ মশা জন্মায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্দেশক ব্রেটো ইনডেক্স ২০-এর ওপরে, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০-এর ওপরে ইনডেক্স থাকা মানেই সেখানে ডেঙ্গু বিস্তারের উচ্চ ঝুঁকি।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
বর্তমানে বরিশাল বিভাগ, বিশেষ করে বরগুনা ও বরিশাল জেলা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেল অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুরে ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করতে পারে।
মে মাসের তুলনায় জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি এই আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করেছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব জ্যামিতিক হারে বেড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
ডেঙ্গুর বিস্তারের কারণ
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ যে হারে বেড়ে চলেছে, তা আর কেবল একটি মৌসুমি রোগ হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি একটি জটিল ও বহুমাত্রিক জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে। ডেঙ্গুর বিস্তারের পেছনে একাধিক পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, ও নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিবর্তন।
দেশের শহরাঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায় অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের ফলে তৈরি হচ্ছে মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ। নির্মাণাধীন ভবনে খোলা ড্রাম, বালতি, পানির ট্যাংক কিংবা পরিত্যক্ত ভবনে দিনের পর দিন জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেখানে অনায়াসে এডিস মশা বংশবিস্তার করে।
বহুতল ভবন গুলোর বেজমেন্টে গাড়ির পার্কিং এবং গাড়ি ধোয়ার জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে মশার আদর্শ প্রজনন স্থল। কিছু কিছু এলাকাতে পানির সংকট থাকার কারণে বৃষ্টি বা সাপ্লাইয়ের পানি ড্রাম, বালতি এবং অন্যান্য পাত্রে ধরে রেখে নাগরিকরা সৃষ্টি করছে মশার অনন্য বাসস্থান।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তন এখন এডিস মশার বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার ওঠানামা ও আর্দ্রতার তারতম্য এডিস মশার জীবনচক্রে সহায়তা করছে এবং ভাইরাস সংক্রমণ আরও দ্রুত হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অল্প সময়ের বৃষ্টিতে যখন বিভিন্ন ছোট বড় পাত্রে পানি জমে থাকে, তখন তা দ্রুত মশার প্রজননস্থলে রূপ নেয়।
অতএব, ডেঙ্গুর বর্তমান এই পরিস্থিতি শুধু একটি রোগ নয়, বরং এটি জলবায়ু, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সম্মিলিত সংকট, যার সমাধান জরুরি। এই সংকট মোকাবিলায় ব্যাপক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় ডেঙ্গু সংক্রমণ খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। একটি ভবনে একজন আক্রান্ত হলে অল্প সময়েই সেই রোগ আশপাশের অনেককে সংক্রমিত করে ফেলে। শহরের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিক বোতল, ফুলের টব, ক্যান বা প্যাকেটজাত খাবারের খালি কৌটা, সবই মশার ডিম পাড়ার জন্য যথেষ্ট।
নগরজীবনে প্যাকেটজাত ও ক্যানজাত খাবারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ধরনের জিনিসপত্র যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যা মশার বংশবিস্তারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির ফলে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতা ও উচ্চ আর্দ্রতা এডিস মশার জন্য অত্যন্ত উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। মশারা খুব অল্প পানিতেও ডিম দিতে পারে এবং মাত্র ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই সেই ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্মে যায়।
এভাবে টানা বৃষ্টি ও অনিয়ন্ত্রিত পানি নিষ্কাশনের অভাব ডেঙ্গুর বিস্তারকে জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে তোলে। পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং অকার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে শহরের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় পাত্রে পানি জমে থাকে, যা যদি সময়মতো ধ্বংস না করা হয় তবে মশা নিয়ন্ত্রণের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমন্বিত কৌশল জরুরি
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ধ্বংস সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলেও দেশে অনেক এলাকায় নিয়মিত মনিটরিং বা লার্ভা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। জনবল সংকট, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনগুলো এ কাজে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। এর ফলে অনেক এলাকায় নিভৃতে লার্ভা বেড়ে উঠছে এবং তা ডেঙ্গুর বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে।
এর পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবও ডেঙ্গু মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জানেন না কোথায় মশা ডিম পাড়ে, কীভাবে লার্ভা ধ্বংস করতে হয়, কিংবা এডিস মশা কখন কামড়ায়। কেউ কেউ জানলেও দায়িত্ববান আচরণ করেন না, বাড়ির ছাদ, বারান্দা বা আঙিনায় জমে থাকা পানির প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করেন না।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত এবং সমন্বিত কৌশল। এটি কেবল ফগিং বা কীটনাশক ছিটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; বরং এডিস মশার প্রজননচক্র ধ্বংস করাই হতে হবে মূল লক্ষ্য। এ জন্য প্রথমেই যেটি জরুরি, তা হলো; মশার প্রজননস্থল শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা।
বাড়ির ছাদ, বেজমেন্ট, বারান্দা, আঙিনা, বাথরুম, রান্নাঘর কিংবা আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, সেসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির ছাদ বা আঙিনায় রাখা ফুলের টব, বালতি, কৌটা, পানির ড্রাম কিংবা পরিত্যক্ত পাত্রে বৃষ্টির পানি জমা হতে না দেওয়ার বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্বশীল হতে হবে।
একই সঙ্গে খোলা জায়গায়, রাস্তার পাশে, নির্মাণাধীন ভবন ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চত্বরে যেন কোথাও পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ডেঙ্গুর হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।
যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে অন্তত ২০০ মিটারের মধ্যে ফগিং, লার্ভিসাইড ছিটানো এবং লার্ভা সার্ভে চালানো আবশ্যক। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশে উড়ন্ত এডিস মশা বেঁচে থাকলে তারা সহজেই অন্যদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিলেই চলবে না, তাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকাকেই মশামুক্ত রাখতে হবে।
এডিস মশা নির্মূলে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাই পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ লার্ভিসাইড ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ড, মহল্লা বা ইউনিয়নে নিয়মিত লার্ভা পর্যবেক্ষণ, তথ্য বিশ্লেষণ ও ফলাফলভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মশার ঘনত্ব, আবহাওয়া ও রোগীর তথ্য সমন্বিতভাবে বিশ্লেষণ করে আগাম পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি গ্রহণ করাও একটি সময়োপযোগী কৌশল হতে পারে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষকদের একাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
তথ্যভিত্তিক উদ্যোগ ও গবেষণা সংযুক্তি
প্রতিটি ওয়ার্ড বা ইউনিয়নে লার্ভা পর্যবেক্ষণ, তথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ চালু করতে হবে। আবহাওয়া, রোগীর সংখ্যা ও মশার ঘনত্বের তথ্য বিশ্লেষণ করে আগাম পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা দরকার।
জনগণের অংশগ্রহণ সফলতার চাবিকাঠি
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শুধু সরকারের একার পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া এই যুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। নিজ নিজ বাড়ি, এলাকা ও কর্মস্থলে প্রত্যেকে যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে এবং মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, তাহলেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।
স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মন্দির ও অফিসে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো জরুরি। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, গবেষক ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগই পারে ডেঙ্গুকে একটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসতে। কারণ, ডেঙ্গু আর কেবল একটি রোগ নয়, এটি জাতীয় সংকট, যার সমাধান চাই সম্মিলিত লড়াইয়ে।
ড. কবিরুল বাশার : অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
এসএন /সীমা
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: