শতবর্ষী কলেজে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলছে ১১ হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদান
প্রকাশিত:
২২ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:২২
আপডেট:
২২ নভেম্বর ২০২৫ ১৪:৪৫
শত বছরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন— দেয়ালের বুকে জালের মতো ফাটল, খসে পড়া পলেস্তরার নিচে উঁকি দেয় মরিচা ধরা রড। ভবনটির ইতিহাসও যেন এখন নিজের জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। এমনি জরাজীর্ণ এই ভবনে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদান চলে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষার বাতিঘর হিসেবে খ্যাত বাগেরহাট শহরের হরিনখানায় অবস্থিত সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজটি এখন দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক ও হতাশার প্রতীক হয়ে।
ঐতিহ্যবাহী কলেজটি শতবর্ষ পার করলেও শিক্ষক সংকট, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, আবাসিক সুবিধার অভাব, আধুনিক হলরুম–সেমিনারকক্ষ না থাকাসহ এমন নানামুখী সংকটে ন্যুব্জ। পুরোনো ব্যবস্থাপনা, জনবল সংকট আর ভগ্ন অবকাঠামোর ওপর ভর করেই চলছে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম। কলেজের অধ্যক্ষ জানান, কর্তৃপক্ষকে বারবার অবহিত করলেও এখনো আসেনি কার্যকর কোনো সমাধান।
কলেজ সূত্র জানায়, বর্তমানে সবাগেরহাট সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের পাঠদানের জন্য ৬৮টি অনুমোদিত শিক্ষক পদের মধ্যে ৩৩টি পদ এখনো শূন্য পড়ে আছে। বর্তমানে কলেজে প্রভাষক পদ রয়েছে ৩৪টি, যার মধ্যে ১৩টি শূন্য। সহকারী অধ্যাপকের ১৭টি পদের মধ্যে ৯টি শূন্য রয়েছে। উপাধ্যক্ষ ও বাংলা বিভাগীয় প্রধানের পদ খালি পড়ে আছে। পদার্থ বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নাম অনুসারে ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটি একশ বছর পেরিয়েও এখনো পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো ও জনবল সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
কলেজের পুরাতন ও জরাজীর্ণ ভবনগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনই ক্লাস করেন শিক্ষার্থীরা। কলেজের মোট পাঁচটি ভবনের মধ্যে দুইটি ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে শ্রেণি কক্ষ থাকা উচিত ৮৪টি, সেখানে চালু আছে মাত্র ৪টি। যেগুলোর বেশিরভাগই আংশিক ভগ্নদশায়। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের অভাবে পরিত্যক্ত ভবনের ভগ্নদশা শ্রেণিকক্ষেও পাঠদান হয় বলে জানা গেছে। নেই কোনো আধুনিক অডিটোরিয়াম, নেই সেমিনার কক্ষ। ১১টি বিভাগীয় কার্যালয়ের মধ্যে ৫টির অবস্থাই নাজুক। সব মিলেয়ে প্রতিদিন মারাত্মকভাবে পাঠদান বিঘ্নিত হয়।
শিক্ষক সংকট এ কলেজের আরেকটি বড় সমস্যা। অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে প্রতি বিভাগে থাকার কথা ১২ জন করে শিক্ষক, সেখানে কোনো কোনো বিভাগে আছে মাত্র একজন, আবার কোথাও ২ থেকে ৪ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে পুরো বিভাগের কার্যক্রম। ফলে একই শিক্ষককে একাধিক কোর্স ও অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না মানসম্মত পাঠদান। সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট ও রোভার স্কাউটের কোনো আলাদা ভবন নেই।
১১ হাজার শিক্ষার্থীর পরিবহন সুবিধা বলতে রয়েছে একটি ৪৫ সিটের বাস। মনোবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ, ভূগোল, কৃষিশিক্ষা, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং, মার্কেটিং এবং পরিসংখ্যান বিষয় চালু না থাকায় প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হতে পারছেন না।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্রী নুসরাত বলেন, পরিত্যক্ত ভবন দেখে ভয় লাগে। কিন্তু নতুন ক্লাসরুমের ব্যবস্থা না থাকায় সেখানেই পড়তে হয়। নিরাপত্তা নিয়ে আমরা সবসময়ই চিন্তায় থাকি।
অনার্স প্রথম বর্ষের মেহেদী হাসান বলেন, বাথরুম সংকট আমাদের প্রতিদিনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ। ছেলেদের বাথরুমে পর্যাপ্ত পানি থাকে না, টয়লেট ভাঙা, দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না। আমরা অনেক সময় হাত-মুখ ধোয়ার জায়গাও খুঁজে পাই না। এত বড় কলেজে আধুনিক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাথরুম থাকা উচিত। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব নতুন বাথরুম নির্মাণ করা হোক, আর পুরোনোগুলো সংস্কার করা হোক। এটা আমাদের জন্য আর বিলাসিতা নয়, জরুরি প্রয়োজন।
উদ্ভিদবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের মাহিন আক্তার বলেন, ভবন সংকট এখন এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে ক্লাস করার সময় মনে ভয় কাজ করে। পরিত্যক্ত ভবনগুলোতে ফাটল, ছাদ খসে পড়া, দেয়াল ভেজা সব মিলিয়ে আতঙ্ক নিয়ে ঢুকতে হয়। নতুন ভবন ছাড়া এই সংকট কাটবে না। এ কলেজে অনেক শিক্ষার্থী, কিন্তু ভবন এখনো অনেক বছরের পুরোনো। আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই নতুন ভবন নির্মাণ ছাড়া আমাদের শিক্ষা জীবনে স্থিতি ফিরবে না।
মাস্টার্স শিক্ষার্থী সোহেল রানা বলেন, সেমিনার হল না থাকার কারণে আমাদের অনার্স-মাস্টার্সের পাঠদান বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিভাগের সেমিনার ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, গ্রুপ আলোচনা কিছুই ঠিকমতো করা যায় না। একটি কক্ষে ৫০-৬০ জনকে নিয়ে সেমিনার করার কল্পনাই করা যায় না। উচ্চশিক্ষার মান ধরে রাখতে হলে আধুনিক সেমিনার হল অপরিহার্য। এখানে সেটা না থাকায় আমাদের গবেষণা, অ্যাসাইনমেন্ট, মৌখিক উপস্থাপনা সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা চাই খুব দ্রুত একটি পূর্ণাঙ্গ, প্রযুক্তিসম্পন্ন সেমিনার হল নির্মাণ করা হোক।
অনার্স চতুর্থ বর্ষের বিজয় বলেন, আমাদের শুধু ক্লাসরুম সংকটে না, পুরো পরিবেশটাই সংকটে পরিণত হয়েছে। আমাদের পড়াশোনার মান প্রতিদিনই কমছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন বাহিরে বন্ধুদের কলেজ জীবন দেখি, আর নিজের কলেজের এই বাস্তবতা ভাবি। এত বড় কলেজে কিন্তু ন্যূনতম সুবিধা নিয়ে পড়তে চাই, সাহায্য নয় অধিকার হিসেবে চাই।
সরকারি পিসি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক তাপশ কুমার চন্দ্র ঘরামী বলেন, হল সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থীর থাকার জায়গা নেই। থাকার ব্যবস্থা সমাধান হলে শিক্ষার্থীরা আরও মনোযোগী হতে পারবে। এত বড় একটি কলেজ জনবল সংকট ও ভগ্নদশা ভবন দিয়ে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন। আমরা বারবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। শিক্ষক নিয়োগ, নতুন ভবন নির্মাণ ও বিভাগ চালুর বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সরদার রইস উদ্দিন বলেন, আমার বিভাগে শিক্ষার্থী আছে, ক্লাস আছে কিন্তু শিক্ষক নেই। ব্যবস্থাপনা বিভাগের শক্তিশালী উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও আমরা সবচেয়ে বেশি সংকটে। বিভাগ চালাতে গিয়ে প্রতিদিনই চাপের ভেতর থাকতে হয়। এই সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলছে, কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থাপনা বিভাগে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানাই, নইলে অনার্স-মাস্টার্সের মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
কলেজের প্রভাষক নিপুণ মণ্ডল বলেন, ভবন সংকট, ক্লাসরুম সংকট আর শিক্ষক স্বল্পতা এই তিনটা সমস্যায় এখন কলেজের পুরো ব্যবস্থা প্রায় থমকে গেছে। একটি শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এমন হওয়া উচিত নয়। শ্রেণিকক্ষের অভাবে শিক্ষার্থীরা মাঝে মধ্য দাঁড়িয়ে ক্লাস করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়- এটা কারও জন্যই গ্রহণযোগ্য না। শিক্ষক সংকটের কারণে আমরা প্রতিদিন অতিরিক্ত ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছি। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি নতুন ভবন, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ এবং দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই, এখনই পদক্ষেপ দরকার।
পরিত্যক্ত ভবনের একটি শ্রেণিকক্ষ
কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ জিয়াউল ইসলাম বলেন, কলেজের সংকট ও সমস্যা নিয়ে ইতোমধ্যে সচিবালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, লিখিতভাবেও পাঠানো হয়েছে। এত বড় প্রতিষ্ঠানে এত শিক্ষার্থী, কিন্তু সুবিধা আগের মতোই রয়ে গেছে। এই অবস্থায় মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। নতুন ভবন, আরও শ্রেণিকক্ষ, পর্যাপ্ত শিক্ষক, সেমিনার হল এসব ব্যবস্থা এখনই প্রয়োজন। আমরা আশা করছি দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কারণ সমস্যাগুলো আর টেনে নেওয়ার মতো নয়।
একশ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সরকারি পিসি কলেজ আজ নানা সংকটে জর্জরিত। ভগ্নদশা ভবন, শিক্ষক সংকট, বিভাগীয় সীমাবদ্ধতা, পরিবহনের অভাব এবং সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনই লড়াই এখন তাদের স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল না থাকায় একটি সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানের মান ও মর্যাদা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সম্পর্কিত বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: