বুধবার, ২৩শে জুলাই ২০২৫, ৮ই শ্রাবণ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


আমার সন্তান কি নিরাপদ?


প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২৫ ১০:৩৮

আপডেট:
২৩ জুলাই ২০২৫ ১৮:২০

ছবি সংগৃহীত

চোখ বন্ধ করে শৈশবে ফিরে গেলাম। বাবা সারাদিন অফিসে খাটছেন আর মা সংসারে। দুজনে মিলে দুই সন্তান, পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ তাদের জীবনের সব দায়িত্ব পালন করছেন। পাড়ার একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করে দিলেন মা। নিজেই দিয়ে আসেন ও নিয়ে আসেন।

মাঝে মাঝে নিজে না পারলে স্কুলের ভ্যান ঠিক করে দেন। চলে আসি বাসায়। বাসায় ফিরে খেলায়, আনন্দে, লেখাপড়ায় সময় কেটে যায় নির্বিঘ্নে! শৈশবে আমার বাবা-মা তাদের সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ দিয়েছেন।

এ ঘটনার বহু বছর পর আমি নিজেই আমার কন্যাকে নিয়ে সিনজিতে করে বাড়ি ফিরছি। চালক গল্প করতে শুরু করলেন। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। সিএনজি চালিয়ে যে টাকা পান তা দিয়েই জন্মদিন পালন করে মেয়ের শখ পূরণ করেছেন দুই দিন আগে, সে গল্প শোনালেন। কত কষ্টের অর্থ আর সে অর্থ দিয়ে সন্তানদের ভালো রাখার গল্প করতে করতে প্রায় কেঁদে ফেললেন।

আমার বাসার তিনজন কর্মীর তাদের সন্তানদের সাথে সম্পর্কের গল্পও লিখতে ইচ্ছে করছে। যিনি ঘর পরিচ্ছন্ন করেন তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েকে সুন্দরভাবে লেখাপড়া করাচ্ছেন কিন্তু ছেলের ক্ষেত্রে অনেক চেষ্টা করেও পারেননি। অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন। কিন্তু তাই বলে সন্তানকে ছেড়ে দেননি বা যাননি। ছেলের কী খাবার ভালো লাগে, পোশাক কেনা; এসব নিয়েই সারাদিন ভেবে যাচ্ছেন। সন্তানের কথা মনে হলেই কতভাবে সন্তানের ভালোর জন্য পাশে থাকতে পারবেন তাই ভাবেন।

ঘরে যিনি রান্না করেন তার ১৯ বছর বয়সের এক ছেলে বিল্ডিং-এ রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে পড়ে মারা যায়। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার কথা মনে করে সে প্রায়ই কেঁদে ফেলে! গাড়ি চালকের ছেলে মারা গেছে ১৭ বছর বয়সে। ইজতেমায় গিয়ে নদীর ধারে বসে ওজু করার সময় হঠাৎ এক নৌকা দাপটের সাথে তীরে ভিড়ে ঠিক সেখানেই, যেখানে ছেলেটি ওজু করছিল। নৌকার গলুইয়ের একটা অংশ ছেলেটির ডান দিকে শরীরের মাঝ বরাবর প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু না হলেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রচণ্ড ব্যথায় ইন্টারনাল অর্গান ড্যামেজের কারণে ছেলেটির মৃত্যু হয়।

আমরা নিজেরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক মায়ের মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন সন্তানদের শেকলবন্দি করার ছবি দেখেছি। সন্তানকে একা ছেড়ে দিলে কোথায় চলে যাবে, দেখার কেউ নেই, এমন কোনো সংস্থা নেই যাদের কাছে কাজের কিছুটা সময় সন্তানকে রেখে আসা যায়!

নিরুপায় এক মা মাটিতে গর্ত করে শিশুকে সেখানে ঢুকিয়ে রেখে বাড়ির সব কাজ সেরে নেন। বিষয়টি অমানবিক কিন্তু নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আর কি পরামর্শ দিয়ে এই মায়ের পাশে থাকা যায় সেটা আমি ভেবে পাই না তবে তাই বলে এভাবেও একটা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও মেনে নিতে পারি না!

চা বাগানে পিঠে শিশু সন্তানকে কাঁধে নিয়ে কাজের দৃশ্য আমাদের কাছে বেশ স্বাভাবিক। সময়ের সাথে এটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক চিত্র মনে হয়েছে। কিন্তু এমনও কি হতে পারে না যে সন্তানকে কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও রেখে তারপর কাজ করছেন? এটা কি একই সাথে শিশু সন্তান ও মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো না?

এমন অসংখ্য গল্প আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিসটিয়ে আছে। দিন শেষে বাবা-মা চান সন্তান যেন নিরাপদে থাকে। আমি যদি বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, রাস্তা পার হওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ভয় অনুভব করি। কোনো স্থানে কনস্ট্রাকশনের কাজ চললে ভয়ে থাকি কখন জানি মাথায় কিছু পড়ে! সব সময় না হলেও পড়তেই পারে!

১০ জানুয়ারি ২০২৪। ঢাকার মগবাজার এলাকায় অফিস ফেরত ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপু মারা যান মাথায় ইট পড়ে। পরবর্তীতে এই ঘটনার কোনো সমাধান করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা।

আমরা নিরাপত্তার অভাবে ভুগি যখন বাজার থেকে খাবার কিনি। খাবারে ফরমালিন মেশানো হয়—এই কথা কে না জানে! একবার এক নারীর গল্প শুনেছিলাম। তার গর্ভপাত হওয়ার পর খতিয়ে দেখা গেল ফরমালিনের উপস্থিতি একটা বড় প্রভাব রেখেছে! আমরা যে জুস খাই, মাছ খাই, মুরগি খাই; এগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কে কি আমরা প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তুলে যাচ্ছি না? এগুলো কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তিল তিল করে মারছে না?

যখন সন্তান বাসার বাইরে খেলতে যায় অপহরণসহ নানা কারণেই নিরাপত্তায় ভুগি। পত্রিকায় পড়ি যে কীভাবে জমি বা সম্পদ নিয়ে মারামারির জের হিসেবে সন্তানকে ভয়ানক পদ্ধতিতে মেরে ফেলা হয়! গ্রামের পুকুর আমাদের শিশুদের জন্য মৃত্যু ফাঁদ, শহরের খোলা ম্যানহোল, নালা, বিদ্যুতের ঝুলে থাকা তার, বিল্ডিং কোড না মেনে বেড়ে ওঠা ভবন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ ফাঁদ কোথায় নেই?

আমাদের চারপাশে নিয়মনীতির বালাই নেই বললেই চলে। রূঢ় সত্য আমাদের মানতেই হবে। কারণ এই যে সর্বক্ষণের আতঙ্ক যে, কখন, কোথায় কী হয়ে যায়; এটা তো কোন স্বাভাবিক বেঁচে থাকা নয়! এটা আমাদের ভেতরে ভেতরে মানসিক নিরাপত্তার দেয়ালেও আঘাত করে!

সন্তানের পাস করা নিয়ে চিন্তা, কোথাও ভর্তি হওয়ার চিন্তা, জিপিএ ফাইভ-এর চিন্তা, ভালো চাকরি পাওয়ার চিন্তা; এত সব চিন্তার মধ্য দিয়ে যাওয়া আমাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত চারপাশের ময়লা আর আবর্জনায় ভরা পরিবেশে কীভাবে সুন্দর স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকবে সেটা ভেবেই কুল পান না!

মশার উৎপাত এ শহরে তো লেগে আছেই! এর পাশাপাশি শিশুদের ধর্ষিত হওয়ার খবর পত্রিকায় আসে! নিজ পরিবারেও শিশুরা ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়!

আমরা প্রতিনিয়ত নানা রকমের নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদের পড়ে যায়! ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোথায় স্কুল হবে, কোথায় শপিং মল হবে, কোথায় সরকারের অফিস হবে; কোথায় মাঠ হবে, কোথায় পার্ক হবে এর জন্য কোনো নগর পরিকল্পনা আমাদের থাকবে না? প্রতিনিয়ত উপরের দিকে দালান উঠেই যাচ্ছে! ঊর্ধ্বমুখী দালানগুলো যখন একটা সময় পর সেকেলে হয়ে যাবে তখন কী হবে? আমাদের দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব একটা জাতিগত চরিত্র। আমিসহ আমরা সবাই ভাবি আচ্ছা, এভাবে একটা কিছু হোক তারপর সমস্যা হলে দেখা যাবে!

এভাবেই অনুমোদন পেয়ে যায় অনেক ভবন যেখানে খাবারের দোকানগুলো ব্যবসা খুলে বসে। নানা দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা গেছে বহু মানুষের স্বপ্ন! একজন সিঙ্গেল ফাদারের বুয়েটে ভর্তি হওয়া বড় কন্যার মৃত্যুর সময়কার আহাজারি আমি আজও ভুলিনি! “ভাই, বুকটা ফেটে যায়!” এইসব বাবা-মায়েদের জন্য আমাদের কী সান্ত্বনা হতে পারে? কী বলে বোঝাবো যে, একদিন মরতেই হবে? কার কখন মৃত্যু হয় কেউ জানে না? দুর্ঘটনা যেকোনো সময় হতে পারে? নাকি একটু দূর ভবিষ্যতের কথা ভাববো? পরিকল্পনা করবো?

কখন, কোথায়, কার মৃত্যু হয় কেউ জানে না। কথা সত্য কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলে এই মৃত্যুগুলো মেনে নেওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়! তখন সরকার নিয়ে, রাষ্ট্রের সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন আসে মনে। কথা হলো সমাজে আইন থাকবে, নিয়ম থাকবে, সাধারণের প্রতি রাষ্ট্রের নানা সাপোর্ট থাকবে।

জনগণ তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে অপহরণ, ট্রাফিকে মৃত্যু, দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগবেন না। বাড়িতে বাস করে মশার কামড়ে মানুষ মরবে সেটা নিয়েও উদ্বিগ্ন হবেন না! আইন কড়া হলে আর প্রশাসন সৎভাবে কাজ করলে কি সমস্যা আরেকটু কমে যাওয়ার কথা না? অবশ্যই। দুর্নীতির দিকেই ইঙ্গিত করছি!

নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নেওয়া বা এগিয়ে যাওয়া এই জাতি যেভাবে অন্ধের মতো ছুটছে তাতে কোনো না কোনো কিছুর সাথে সংঘর্ষে আঘাত নিশ্চিত! এত বছরে আমরা কোথায় পৌঁছাতে পেরেছি? কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছি? আমাদের অর্জন কী? এগুলো নিয়ে ভেবে আর এমন সব আক্ষেপে ভরা লেখা লিখেই কি শেষ হবে আমাদের জীবন?

ফারহানা মান্নান : প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক

এসএন /সীমা


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top