শনিবার, ৫ই জুলাই ২০২৫, ২১শে আষাঢ় ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


বেগম জিয়া শুধু বিএনপি নয়, জাতির অভিভাবক


প্রকাশিত:
৫ জুলাই ২০২৫ ১৩:৫৬

আপডেট:
৫ জুলাই ২০২৫ ১৯:২৫

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়া এক অবিস্মরণীয় নাম। তার রাজনৈতিক জীবন কেবল একটি দলের নেতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নারী নেতৃত্ব এবং জাতীয় সংকটকালীন সময়ে আপসহীন এক প্রতিরোধের প্রতীক।

আজ যখন দেশের গণতন্ত্র, বিচারিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক ভারসাম্য গভীর সংকটে, তখন বেগম খালেদা জিয়ার অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা জাতির জন্য এক ধরনের অভিভাবকত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসা ছিল ঘটনাচক্রে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যখন বিএনপির নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে, তখন তাকে দলের দায়িত্ব নিতে বলা হয়। শুরুতে একজন গৃহিণী থেকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা নারী হিসেবে তার প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি প্রমাণ করেন, নেতৃত্বের জন্য প্রথাগত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নয়, দরকার দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা ও জনসম্পৃক্ততা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন তিনবার। তার নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষা খাতে প্রসার ঘটেছে। ২০০১ সালে তার সরকার গ্রামীণ বিদ্যুৎ ও শিক্ষাব্যবস্থায় বড় আকারের পরিবর্তন আনে।

সেই সঙ্গে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেন তিনি। সরকারের দলের পাশাপাশি বিরোধী দলেও বেগম জিয়ার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যান।

১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যতের মুখে পড়ে। ওই সময়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটি অংশগ্রহণমূলক ও দায়িত্বশীল নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল তার অন্যতম দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে তিনি দেশকে একটি স্থিতিশীল সাংবিধানিক কাঠামোয় ফিরিয়ে আনেন এবং সামরিক শাসনের কালো অধ্যায়ের ইতি টানেন।

১৯৯৪ সালে নির্বাচন ব্যবস্থার সংকটকালীন সময়ে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মাঝেও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজেছিলেন। বিরোধীদের সংসদ বর্জনের পরও তিনি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথ উন্মুক্ত করেন, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এক নতুন ধারা তৈরি করে।

২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি ৯/১১ পরবর্তী বিশ্বে সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং দেশে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ‘জামাতুল মুজাহিদিন’সহ চরমপন্থি সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন।

২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়। কারাগারে থেকেও তিনি সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আচরণের আহ্বান জানান। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর তিনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান।

সরকার তাকে অবরুদ্ধ করলেও তিনি সংঘর্ষ নয়, সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাস রেখে ধৈর্য বজায় রাখেন। ২০১৮ সালে তার কারাবন্দি অবস্থায় বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও বিন্দুমাত্র সাহস হারাননি বেগম জিয়া ও তার দল। যা প্রমাণ করে—তিনি শুধু একজন নেতা নন, বরং একটি দলের আদর্শ ও চেতনার প্রতীক।

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনসহ বিগত রাজনৈতিক দমন-পীড়নের সময়ও তিনি বারবার শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের ডাক দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তিনি সংঘর্ষ নয়, সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু সাবেক স্বৈরাচার সরকার খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় বরং তাদের দল দেশকে এক কঠিন অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে বিদেশ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

এক দশকে তাকে নানা মামলা, গৃহবন্দি হওয়া ও চিকিৎসা সংকটের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়েছে। তাকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার এক ধারাবাহিক প্রয়াস চলেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা। অথচ এই সময়েও তার দল ও অনুসারীরা তাকে ছাড়া রাজনীতিকে কল্পনাই করতে পারে না। তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ, সহানুভূতি ও ঐক্য প্রমাণ করে যে তিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি একটি আন্দোলনের নাম।

বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যখন গণতন্ত্রের ক্ষেত্র সংকুচিত, বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ এবং প্রশাসন দলীয়করণ, তখন একজন অভিজ্ঞ, ধৈর্যশীল ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব প্রয়োজন। খালেদা জিয়া আজ রাজপথে নেই, তবে তার নীতিনির্ধারণী অবস্থান, রাজনৈতিক পরামর্শ ও আস্থাভাজন অবস্থান বিএনপিসহ সমগ্র বিরোধী রাজনৈতিক বলয়ের জন্য এখনো দিকনির্দেশক।

তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা এবং জাতীয় ঐক্য গঠনের সক্ষমতা বর্তমান সংকটে অভিভাবকের ভূমিকায় তাকে নিয়ে এসেছে। একজন নেতা যখন তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে পেছনে ফেলে জনগণের মুক্তির কথা ভাবেন, তখন তিনি কেবল রাজনীতিবিদ থাকেন না—তিনি হয়ে ওঠেন অভিভাবক।

বাংলাদেশের জন্য সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। খালেদা জিয়া আজ সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় নাও থাকুন, তবে একটি সমঝোতাভিত্তিক রাজনীতি ও সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় তার মতামত, নৈতিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক অবদান এখনো অপরিহার্য।

যেকোনো জাতীয় ঐক্য সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন বা সাংবিধানিক সংস্কারের প্রশ্নে তিনি এমন এক নেত্রী যিনি বিশ্বাসযোগ্য, নিরপেক্ষ ও পরীক্ষিত। তার উপস্থিতি ও চিন্তা-ভাবনা অনেক তরুণ রাজনীতিক ও জনগণের কাছে আশার আলো।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন যাত্রা অনেক সংগ্রাম, বঞ্চনা, সাফল্য ও আত্মত্যাগে ভরপুর। তার প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল দলমত ঊর্ধ্বে দেশের জন্য, দলের জন্য এবং জনগণের জন্য। আজ তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কিন্তু তার আদর্শ, প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টি এখনো জাতির জন্য প্রয়োজনীয়। যারা এই জুলাই আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

দেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যখন নানা সন্দেহ সংকট, কানাঘুষা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় ঠিক তখনো আলোর প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছেন বেগম জিয়া। তিনি বলেছেন কোনোভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা যাবে না। সব পক্ষের মধ্যেই ঐক্যমত্য সৃষ্টিতে তার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।

জীবনের কঠিন সময়ে যখন দেশের বিগত সময়ের তথ্যকথিত নেতা নেত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, সেই কঠিন মুহূর্তগুলোতেও দেশ ছাড়েননি তিনি। বলেছিলেন, ‘দেশের বাহিরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশ, দেশের মাটিই আমার একমাত্র ঠিকানা।’

যখন রাজনীতি হারাচ্ছে তার নৈতিকতা, যখন প্রজন্ম হারাচ্ছে দিকনির্দেশনা, তখন খালেদা জিয়ার মতো অভিজ্ঞ ও মানবিক নেতার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভূত হয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে তিনি এখনো একমাত্র জাতীয় অভিভাবক—যিনি পারেন সবাইকে একত্রিত করতে, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে এবং ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে।

শাহেদ শফিক : সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

ডিএম /সীমা


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top