ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, প্রয়োজন জনসম্পৃক্ততা!
প্রকাশিত:
৩ জুন ২০২৫ ১১:০৩
আপডেট:
৫ জুন ২০২৫ ১১:৫৪

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনাচরণের মাঝেই যোগ্য নাগরিক হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ পাওয়া যায়। জনগণ দেশ ও জাতির সম্পদ। ভোক্তা হিসেবে মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নিয়ত সচল এবং কার্যকর থাকতে হয়। কেননা ভোগ এবং সেবা গ্রহণ ব্যতীত মানবের টিকে থাকা সম্ভব নয়। দেশের সংবিধান আইন মানবাধিকার সর্বত্রই ভোক্তার অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে বেশ সজাগ। সমাজ রাষ্ট্রের সবাই ভোক্তা। যিনি উৎপাদক বিপনণকারী তিনিও সময় ক্ষেত্রে ভোক্তা। অতএব ভোক্তার অধিকার নিশ্চিতকরণ অগ্রাধিকার যোগ্য ইস্যু। অথচ এসবে আমরা কি দেখছি? এ খাতে সরকারের মনোভাব এবং জনতার অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা এসবই বলে দেয় আমাদের অবস্থান। এক্ষেত্রে যৌক্তিক সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সীমিত সম্পদ জনবল ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের সাহসিকতা আন্তরিকতা মনোভাব প্রেষণা এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের পুলকিত করে। এসব ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ ভোক্তার অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তে কৌশল হিসেবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম এবং প্রতিকারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে।
ভোক্তা কারা? এ বিষয়ে সর্বাগ্রে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী যিনি সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করে অথবা আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করে অথবা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত পণ্য ক্রয় বিক্রয় করে তিনিই ভোক্তা। সমাজে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই ভোক্তা। বাংলাদেশের সংবিধানে (২৬- ৪৭)-তে ও এই অধিকারের কথা বলা আছে। যেখানটায় আইনে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়ে থাকে। এবং জরিমানা আদায়ের ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে দেওয়া হয়। অথচ এ বিষয়ে জনগণ খুব বেশি সচেতন নয়। কেন?
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে ২০০৯ সালের আইন যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং এরই ধারাবাহিকতায় ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের গোড়াপত্তন। যদিও ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০ ওজন ও পরিমাপ আইন ১৯৮২ নাগরিকের সর্বোচ্চ সেবা প্রাপ্তিতে সরকারি পদক্ষেপের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ভোক্তার স্বার্থই অগ্রাধিকার যোগ্য। যা রাষ্ট্র সব সময় স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন সম্ভব হয় না। তারপরও থেমে নেই। ২০০৯ সালের আইনে (৩৭-৫৬) ধারায় ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘনের অপরাধের বিবরণ বিধৃত হয়েছে। পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, মূল্য কারসাজি, অসত্য ও মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য যথাযথভাবে সরবরাহ না করা, ওজনের কারচুপি এবং মেয়াদবিহীন পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা।
আইন থাকার পরও বাস্তবে কি দেখছি? ভোক্তা সাধারণ সর্বদাই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। চটকদার বিজ্ঞাপনের মুখে সচেতনতার অভাবে প্রদর্শিত পণ্য এবং প্রাপ্ত পণ্যের মাঝে গড়মিল ভেজাল ওজনে কম মানের সাথে আপসকামিতা, বাসি-পচা জীবন ধ্বংসকারী সেবা ও পণ্যের পসরা এবং ডিজিটাল প্লাটফর্মে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এসব রোজকার কারবার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এমন হচ্ছে? বাস্তবতা এবং ব্যপ্তি যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলেই সার্বিক চিত্র আমাদের মাঝে পরিষ্কার হবে এবং এতে উত্তরণের সম্ভাব্য পথ ও খুলে যেতে পারে। কনজ্যুমার ফোরাম ঢাকা শহরের ২৩ এলাকায় ৪০৮ জন ভোক্তার ওপর পরিচালিত গবেষণার উপাত্তে দেখা যায় ৩৬.২০ শতাংশ ভোক্তা আইন সম্পর্কে জানে না। ৪৭.৫৫ শতাংশ অধিদপ্তর সম্পর্কে ধারণা নেই ৩৩. ৩৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অভিযোগ করতে অনীহা। কিন্তু কেন? অথচ ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ থেমে নেই। জন্ম থেকে তাদের উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে। জাগো নিউজ ১৪ মার্চ ২০২২ এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক যুগে এ প্রতিষ্ঠান ৪৯ হাজার ৯৬৮টি অভিযানে ১ লাখ ২০ হাজার ১০২টি প্রতিষ্ঠানকে দণ্ডিত করেছে এবং জরিমানার পরিমাণ ৮৭ কোটি ৫৫ লাখ ১০ হাজার ২৫০ টাকা। যার ৯৫ শতাংশই বাজার অভিযানের মাধ্যমে এসেছে। অভিযোগ এসেছে ৫৬ হাজার ১২৪টি। ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের বিগত দিনের কার্যক্রম অভিযান দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আদায়কৃত জরিমানা এবং অভিযোগকারীকে প্রদেয় টাকার পরিমাণ এসব তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমেয় যে নানাবিধ সংকট জনবলের ঘাটতি সত্ত্বেও দেশ জাতি এবং নাগরিক সেবায় প্রবল মনোবল যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে প্রাণপণ প্রচেষ্টা জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতারকে সামনে রেখে এ প্রতিষ্ঠান যুগান্তকারী অবদান রেখে আসছে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ ২০১৫-১৬ সালে ১৩৯৪টি অভিযান পরিচালনা করেন দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৮৬৫ আদায়কৃত জরিমানা ৩ কোটি ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫০ টাকা তাদের কাজের পরিধি অভিযান এবং বর্ণিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমাগত দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত তারা ১০১৯৮টি অভিযান পরিচালনা করেছে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১ হাজার ৫৫৪ এবং আদায়কৃত জরিমানার পরিমাণ ১৫ কোটি ৩ লাখ ৭৯ হাজার ১০০ টাকা এবং ভোক্তা এই জরিমানার অর্থ থেকে এগার লাখ তের হাজার তিনশ পঁচাত্তর টাকা পেয়েছে।
পদোন্নতির দীর্ঘসূত্রিতা, যানবাহনের সংকট, বরাদ্দের অপ্রতুলতা, সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাকার নেতিবাচক প্রপঞ্চ বিদ্যমান থাকার পরেও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজন যৌক্তিক সংস্কার। এখানটায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো যা নীতিনির্ধারণী মহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে খোরাক জোগাতে পারে। জনবল কাঠামোর যৌক্তিক সম্প্রসারণ, যানবাহনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, মসজিদের ইমাম-খতিব এবং মন্দিরের পুরোহিতদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বক্তব্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা, আইনের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে গণমুখী করা, অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্ম সম্পর্কে আইনের অস্পষ্টতা দূরীকরণ, অধিদপ্তরের ক্ষমতা এবং শক্তি বৃদ্ধিকরণ, সাংবাদিক সুশীল সমাজের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ এবং ইতিবাচক সংবাদের প্রচার, হাটবাজারে অভিযোগে দায়ের নিয়মাবলী এবং শাস্তির বিধান প্রদর্শন, পদোন্নতি নিয়মিত করুন এতে কাজের প্রতি সন্তুষ্টি থাকে এবং স্পৃহা বাড়ে এবং নৈতিকতা এবং ধর্মীয় অনুশাসনের আলোকে পণ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তা, কুফল ও শাস্তির বিষয়ে মানুষকে অবহিত করা।
জুলাই বিপ্লব আমাদের মাঝে নতুন আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। জেনারেশন জেড এবং আলফার চোখে এখন বাংলাদেশ দেখার সুযোগ এসেছে। চরিত্রে নৈতিকতা ধর্মীয় অনুশাসন এবং সামাজিকতা চর্চার মাঝেই বেঁচে থাকার রসদ খুঁজতে হবে। সময় এসেছে জেগে উঠার এবং ভেজাল ত্রুটিযুক্ত পণ্যের কে না বলার।এ বিষয়ে জনমত তৈরি করা প্রয়োজন। মনোভাবের পরিবর্তন মানবিকতার বিকাশ আনার ক্ষেত্রে সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততাই হতে পারে অন্যতম নিয়ামক।
ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস ।। অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: