সরকারবিরোধী আন্দোলনের পথে হাঁটছে বিএনপি?
প্রকাশিত:
২০ মে ২০২৫ ১৯:২২
আপডেট:
২০ মে ২০২৫ ১৯:৩২

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন তার সমর্থকরা। নগর ভবনে তালা লাগিয়ে ইশরাক সমর্থকদের অবরোধের কারণে দক্ষিণ সিটি কার্যালয়ে কার্যত অচলাবস্থাও দেখা যাচ্ছে। মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেন শপথ নিতে পারবেন কী-না সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।
এই ইস্যুতে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে ইশরাক হোসেনর কর্মী সমর্থকরা আন্দোলন করলেও এখনো দলগত অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে যায়নি বিএনপি। তবে, এই দাবি মানা না হলে বৃহত্তরের আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে বিএনপির সিনিয়র নেতাদেরও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আমরা এই ন্যায্য আন্দোলনের পক্ষে আছি। প্রয়োজনে দলগতভাবে এই আন্দোলনে আমরা সমর্থন দেব।’
মঙ্গলবারও নগর ভবন অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পদত্যাগের দাবি জানাতে দেখা যায় ইশরাকের সমর্থকদের।
ঢাকায় (সাভারে) এক কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘একদিকে মামলাটা বিচারাধীন অন্যদিকে আইনগত জটিলতাও সামনে এসেছে। সেগুলোর সমাধান হলে আমরা কোনো একটা সিদ্ধান্তের দিকে যাবো।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদটিকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করে যে আন্দোলন হচ্ছে, এটি বিএনপির একটি রাজনৈতিক কৌশল।
অবরুদ্ধ নগর ভবন
গত ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল আগের ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে। এক মাস পরে গত ২৭ এপ্রিল রাতে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। গেজেট হলেও স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে শপথের তারিখ ঘোষণা করা হয়নি এখনো।
ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে তার সমর্থকেরা গত বুধবার থেকে 'ঢাকাবাসী' ব্যানারে নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত শনিবার নগর ভবনের প্রধান গেটসহ বিভিন্ন কক্ষে তালা লাগিয়ে দেয় ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা।
মঙ্গলবারও নগর ভবনের মূল গেটের সামনে মঞ্চ বানিয়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি চলছিল। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় এই কর্মসূচি। এতে অংশ নেওয়া অনেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগেরও দাবি জানান। ইশরাকের সমর্থকরা বলছেন, তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এদিকে, ওই এলাকায় মঞ্চ প্রস্তুত করে কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়েছে গত দুই দিনে। এই অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচির কারণে সকাল থেকে বঙ্গবাজার–গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় গেছে। গোলাপ শাহ মাজার মোড়েও সড়কে অবস্থান নিয়েছেন ইশরাকের সমর্থকেরা।
টানা এই কর্মসূচির কারণে গত কয়েক দিন ধরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। সেবা নিতে এসে ফেরত ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বাসিন্দাদের।
সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই আন্দোলনের ফলে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আন্দোলনকারী ও ইশরাক সাহেবের এটা বুঝতে হবে, এভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি ঠিক হচ্ছে না।’
শুধু দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নয়, গত বছর সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে আগুন লাগার পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যালয় দক্ষিণের নগর ভবনে স্থানান্তর করা হয়।
ফলে শুধু নাগরিক সেবা নয়, এই অবরোধ কর্মসূচির ফলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বিপাকে পড়েছেন।
দলগত আন্দোলনে যাবে বিএনপি?
ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কয়েকদিন ধরে নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ চলছিল 'ঢাকাবাসী' ব্যানারে। এতে ইশরাকের কর্মী সমর্থকরা অংশ নিলেও তাদের কোনো দলীয় ব্যানারে অংশ নেয়নি। তবে সেখানে থাকা অনেকেই বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। এ নিয়ে গত সোমবার পাল্টাপাল্টি ফেসবুক স্ট্যাটাসও দিয়েছেন ইশরাক হোসেন ও আসিফ মাহমুদ।
সোমবারই বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা এই আন্দোলন ঘিরে ঢাকায় বৃহত্তর আন্দোলনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। বিএনপি মনে করছে, বর্তমান সরকার সিটি করপোরেশন ও নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে নানা কৌশলের পথ বেছে নিয়েছে। যে কারণে আন্দোলনই একমাত্র সমাধান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাধারণ জনগণ এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত আছে। এই আন্দোলনে আমরাও (বিএনপি) সমর্থন করছি। সাধারণ মানুষের আন্দোলনে একটা পর্যায়ে অবশ্যই আমাদের সক্রিয়ভাবে দলগতভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে যদি সরকারের টনক না নড়ে।’
বিএনপির এই নেতা বলছেন, ইশরাককে শপথ পড়াতে সংবাদ সম্মেলনসহ নানাভাবে দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। কিন্তু তারপরও দাবি আদায় না হওয়ায় আন্দোলনের দলগতভাবে অংশ নেয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। নগর ভবনে এই অবরোধ কর্মসূচি থেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পদত্যাগও দাবি করেন ইশরাক সমর্থকরা।
দুপুরে সাভারে এক অনুষ্ঠান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সব সময় সরকার একটা বডি হিসেবে কাজ করে। এখানে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে এ ধরনের বড় ইস্যুগুলোতে। আর এই ধরনের ডিসিশনগুলো একা ব্যক্তি হিসেবে আমি নিচ্ছি এটা ভাবার সুযোগ নেই।’
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, চাপ প্রয়োগ করে এই ক্ষেত্রে দাবি আদায় করা বিএনপির জন্য একটু কষ্টসাধ্য হয়ে যেতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইশরাক সাহেব শপথ নিতে পারবেন না। আমার মনে হয়, এই আন্দোলন করে সরকারকে শপথ গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না।’
রিট ও আইনি জটিলতা
২০২০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস বিএনপির ইশরাক হোসেনকে প্রায় পৌনে দুই লাখ ভোটে পরাজিত করেন। তবে চলতি বছরের ২৭ মার্চ একটি নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল সেই ফল বাতিল করে ইশরাক হোসেনকে বৈধ মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন। এর প্রেক্ষিতে ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের পরদিন সুপ্রিম কোর্টের দুইজন আইনজীবী একটি লিগ্যাল নোটিশ দেয়।
পরদিন ২৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদের পাঠানো একটি লিগ্যাল নোটিশে আলোচিত রায় ও শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। এ নিয়ে রিট করা হয় হাইকোর্টে। কমিশনের দেওয়া গেজেট স্থগিত চেয়ে রিটের ওপর মঙ্গলবার শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে বুধবার আদেশ দেবে আদালত।
নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু এই শপথের তারিখ ঘোষণা ঘিরেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ইশরাক সমর্থকরা।
মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘যেহেতু নানা ধরনের আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে, মেয়াদ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে, এই জটিলতা নিরসনে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছি। আদালতে আইনি লড়াই লড়তে হবে এবং যে জটিলতাগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।’
স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওই নির্বাচনে মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শুধু মেয়র দিয়ে তো সিটি করপোরেশন চলে না। ওই নির্বাচনে যারা কাউন্সিলর হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন, তারা যদি এখন একই ধরনের রায় চায় তাদের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে?’
‘এই ধরনের নির্বাচনে কেউ যদি মেয়র পদে বসেন তাহলে বিগত সরকারের সময়ের নির্বাচনগুলোর বৈধতার প্রশ্নগুলোও সামনে আসবে’, যোগ করেন তিনি।
এদিকে ইশরাক হোসেন সমর্থকদের এই কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নও। বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে ইশরাকের শপথের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন। ওই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে তারা কর্মবিরতিরও ঘোষণা দিয়েছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: