হাসিনার প্লট দুর্নীতির মামলায় নাটকীয় মোড়, নভেম্বরে রায় অনিশ্চিত
প্রকাশিত:
১ নভেম্বর ২০২৫ ২১:০৫
আপডেট:
২ নভেম্বর ২০২৫ ০২:৪৭
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে করা পৃথক ছয় মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে পলাতক এক আসামির আত্মসমর্পণের ফলে এসব মামলার বিচারকাজ নাটকীয় মোড় নিয়েছে। এসব মামলার রায় ঘোষণা নভেম্বরের মধ্যে হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হচ্ছে না। সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে পলাতক আসামির আত্মসমর্পণ দ্রুত রায় ঘোষণার অন্তরায় বলে জানিয়েছে দুদক প্রসিকিউশন।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ছয়টি মামলার বিচারকাজ ঢাকার দুই বিশেষ জজ আদালতে চলমান রয়েছে।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলমের আদালতে বিচারাধীন তিন মামলার একটিতে শেখ রেহানা, টিউলিপ সিদ্দিক ও শেখ হাসিনাসহ আসামি ১৭ জন। এ মামলার ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। একই আদালতের আরেক মামলায় আজমিনা সিদ্দিক, টিউলিপ ও শেখ হাসিনাসহ ১৮ জন আসামি। এ মামলায় ২২ সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত। অপর মামলায় রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, টিউলিপ ও শেখ হাসিনাসহ ১৮ জন আসামি। এ মামলায় ২৮ সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এসব মামলায় আগামীকাল ২ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
অপরদিকে, ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে বিচারাধীন তিন মামলার একটিতে শেখ হাসিনাসহ ১২ জন আসামি। এ মামলায় ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। একই আদালতে আরেক মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয় ও শেখ হাসিনাসহ ১৭ জন আসামি। এ মামলায় ২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। অপর মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও শেখ হাসিনাসহ ১৮ জন আসামি। এ মামলায় ২৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছেন আদালত। এসব মামলায় আগামী ৩ নভেম্বর পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। অর্থাৎ ছয় মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুদক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ছয়টি মামলার রায় অক্টোবরের শেষ নাগাদ বা নভেম্বরের মাঝামাঝি হবে বলে আশা করি।
আসামিদের অনুপস্থিতিতে চলা এসব মামলার বিচার দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার আশা ছিল। তবে সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আত্মসমর্পণ করলে বিচার কার্যক্রম নাটকীয় মোড় নেয়। গত ২৯ অক্টোবর (বুধবার) খুরশীদ আলম আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে বিচারাধীন তিন মামলায় তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। তার পক্ষে অ্যাডভোকেট শাহিনুর ইসলাম জামিন চেয়ে শুনানি করেন। দুদকের পক্ষে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর আরেক আদালতে বিচারাধীন তিন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়। এখন আসামির অনুপস্থিতিতে আদালতে হওয়া সাক্ষ্য রিকল (পুনরায়) করার আইনগত সুযোগ থাকায় সাক্ষীদের জেরা করার সুযোগ পাবেন আসামিপক্ষ। এর আগে গত ১৫ অক্টোবর খুরশীদ আলম আদালতে আত্মসমর্পণের দরখাস্ত দিয়েও পালিয়ে যান।
এ বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি বলেন, আসামি আত্মসমর্পণ করে যদি সাক্ষী রিকল করে, এটা তার আইনগত অধিকার। তার আইনগত অধিকারে আদালত অথবা দুদকের বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুদকের মামলার অভিযোগ হলো দালিলিক সাক্ষী। এগুলো অন্যান্য ফৌজদারি মামলার মতো না। সেক্ষেত্রে আসামি খুরশীদের বিষয়ে যে সাক্ষী বলেছেন, উনি (আসামি) শুধু তাকে জেরা করতে পারবেন। উনার সম্পর্কে শুধু তদন্ত কর্মকর্তা কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করতে পারবেন তিনি। সব সাক্ষীকে রিকল করার অবকাশ নেই।
একই প্রক্রিয়ায় অন্য কোনো পলাতক আসামি আত্মসমর্পণ করলে কী হবে– এমন প্রশ্নে দেলোয়ার জাহান রুমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে দুদকের আরেক প্রসিকিউটর খান মো. মইনুল হাসান লিপন বলেন, এখানে যে আসামি আত্মসমর্পণ করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জবানবন্দি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধু তদন্ত কর্মকর্তাকে রিকল করে জেরা করার সুযোগ পাবেন। ইতোমধ্যে তার আইনজীবী তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরাও করেছেন। তাই মামলার বিচার শেষ হতে তেমন বিলম্ব হওয়ার অবকাশ নেই। এসব মামলার অভিযোগই হলো দালিলিক সাক্ষ্য।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনাসহ ওই পরিবারের যারা পলাতক আছেন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ স্পষ্ট। তাদের ঢাকায় সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা মিথ্যা হলফনামা দাখিল করে দুর্নীতি করেছেন। আশা করছি এ অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।
মইনুল হাসান লিপন আরও বলেন, প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। যার বিরুদ্ধে যিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন আদালত প্রয়োজন মনে করলে আসামির আত্মসমর্পণ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সাক্ষীকে রিকল করতে পারেন। বিচার শেষ করার ক্ষেত্রে সাক্ষী রিকলের প্রক্রিয়া তেমন একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে না। আমরা আশাবাদী দ্রুত এসব মামলার রায় ঘোষণা করা হবে এবং আসামিরা পর্যাপ্ত সাজা পাবেন।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যদি কোনো মামলায় অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোনো আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং আদালত সেই আত্মসমর্পণ গ্রহণ করে নেন, তখন আসামির আইনগত অধিকার থাকে তার বিরুদ্ধে দেওয়া সাক্ষ্যগুলো রিকল করার। এই রিকলের প্রক্রিয়াটি সাক্ষ্য আইনের ১৩৮ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ ধারা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। সব আসামি যদি আত্মসমর্পণ করেন, তাহলে সব সাক্ষী রিকল করার সুযোগ আইনে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি খুরশীদ আলমের আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম বলেন, সাক্ষী রিকলের বিষয়ে আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। গত বুধবার আমি প্রথম আদালতে উপস্থিত হই। মামলার রেকর্ড এখনো দেখিনি। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মামলার রেকর্ড দেখে সাক্ষী রিকলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
এসব মামলার অন্য কোনো আসামি আত্মসমর্পণ করার বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত অন্য কোনো আসামি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কেউ এলে অবশ্যই আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন।
প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে এ বছরের জানুয়ারিতে পৃথক ছয়টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), বোন শেখ রেহানা, শেখ রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও অপর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ ২৩ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। অযোগ্য হলেও তারা পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ নেন।
শেখ পরিবারের সদস্য ছাড়া মামলাগুলোতে অন্য আসামিরা হলেন– জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদ, সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ও সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান ও হাবিবুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ও শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন।
গত ৩১ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন তিন মামলায় এবং ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক মো. রবিউল আলম তিন মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
সম্পর্কিত বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: