যেভাবে কৌশলে আল-আকসা ‘দখলে’ নিলো ইসরায়েল, চলছে মন্দির বানানোর পরিকল্পনা
প্রকাশিত:
১৯ আগস্ট ২০২৫ ১৭:০৮
আপডেট:
১৯ আগস্ট ২০২৫ ২০:৩৮

গত মাসের ঘটনা… আল-আকসা মসজিদের ভেতরে ইহুদিরা দলবদ্ধভাবে উচ্চস্বরে প্রার্থনা করছে, গান গাইছে, নাচছে এবং ইসরায়েলি পতাকা ওড়াচ্ছে। পুরুষেরা মাটিতে সেজদা দিচ্ছে। মুসলিমদের অন্যতম পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে এমন দৃশ্য কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে।
ইসলামিক ওয়াকফ-এর আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক আউনি বাজবাজ বলেন, “যেসব ইহুদি সেখানে উপস্থিত ছিল, তাদের সংখ্যা ছিল অনেক এবং তাদের মধ্যে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন।” আউনি বাজবাজের মতে, এসব করে আল-আকসা মসজিদের ওপর ইহুদিদের সার্বভৌমত্ব জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিদেরও সেখানে প্রার্থনার অধিকার দেওয়া যাচ্ছে। যা সুষ্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।”
জেরুজালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের ফিলিস্তিন দখলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ফিলিস্তিনি এবং বিশ্বের মুসলিমদের কাছে এই মসজিদ স্বাধীনতা, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতীক। অপরদিকে ইসরায়েলিদের বিশ্বাস এখানে তাদের তৃতীয় মন্দির বা থার্ড টেম্পল নির্মাণ হবে।
দীর্ঘ সময় ধরে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী, আল-আকসায় শুধুমাত্র মুসলিমদের প্রার্থনা করার অধিকার রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালে পূর্ব জেরুজালেম দখলের পর থেকে ইসরায়েল ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনি ও মুসলিমদের প্রবেশে বিধিনিষেধ বাড়িয়েছে। একই সময়ে, সেখানে প্রবেশাধিকার বাড়িয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের অবৈধ বসতিগুলোতে হামলার এই চর্চা আরও বেড়েছে।
বর্তমানে বিশ্ব যখন গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং সামগ্রিক আঞ্চলিক উত্তেজনার দিকে নজর রাখছে, তখন আল-আকসা মসজিদ এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ফিলিস্তিনি আশঙ্কা করছেন যে, মসজিদটি তার পরিচয় হারাতে চলেছে এবং তারা যা দীর্ঘকাল ধরে ভয় পেয়েছিল, অর্থাৎ এটি তৃতীয় ইহুদি মন্দিরে পরিণত হতে চলেছে।
আল-আকসা মুসলিমদের
উনিশ শতকের শেষদিকে অটোমান সাম্রাজ্য জেরুজালেমের ধর্মীয় স্থানগুলো পরিচালনার জন্য একটি চুক্তি করে। এটি 'স্ট্যাটাস কো' নামে পরিচিত। এ চুক্তিটি বিশ্বের বেশিরভাগ সম্প্রদায় মেনে চলে।
চুক্তি অনুযায়ী, ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গমিটারের আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স—যার মধ্যে রয়েছে ডোম অব দ্য রক, কিবলা মসজিদ এবং অন্যান্য ভবন ও গেট—সম্পূর্ণভাবে মুসলিম প্রশাসনের অধীনে থাকবে।
এই প্রশাসনকে ইসলামিক ওয়াকফ বা ধর্মীয় ওয়াকফ বলা হয়, যা জর্ডানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। নিয়ম অনুযায়ী, মসজিদের ভেতরে শুধু মুসলিমরাই নামাজ পড়তে পারবে। অমুসলিমরা এখানে যেতে পারবে, তবে কখন এবং কীভাবে, তা ওয়াকফ নির্ধারণ করবে। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং খনন কাজের দায়িত্বও সম্পূর্ণভাবে ওয়াকফের হাতে।
১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তিতে আল-আকসায় ইসলামিক ওয়াকফর নিয়ন্ত্রণকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত এই চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কারণ ইসরায়েল আল-আকসায় যেকোনো হামলার ফলে বিশ্ব মুসলিমদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার ভয় করত।
তবে, ২০০২ সালে ইসরায়েলি কুখ্যাত বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন শতশত সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে মসজিদে হামলার পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। এই হামলার পর ফিলিস্তিনিরা বিদ্রোহ শুরু করে। যা দ্বিতীয় ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহের পর থেকে ইসরায়েলি দখলদাররা আরও বেশি করে আল-আকসায় যাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে থাকে।
প্রথমত, ইসরায়েল তাদের সেনাাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের নিয়মিতভাবে মসজিদের প্রাঙ্গণ ও গেটগুলোতে মোতায়েন শুরু করে এবং ফিলিস্তিনিদের মসজিদে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করে। একই সময়ে, ইসরায়েলি ওয়াকফ থেকে আল-আকসার নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয় তারা। এরপর দখলদাররা ব্যাপক আকারে সেখানে যাওয়া শুরু করে।
আল-আকসায় এ ধরনের অনুপ্রবেশের আয়োজন করে ‘টেম্পল মাউন্ট অ্যাক্টিভিস্ট’ নামে পরিচিত বিভিন্ন সংগঠন, যারা আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে তৃতীয় মন্দির নির্মাণের দাবি জানায়। ২০০০ সালের পর থেকে ইসরায়েল প্রকাশ্যে আল-আকসা মসজিদের নিচে খনন কাজ শুরু করে, যা চুক্তির আরেকটি গুরুতর লঙ্ঘন।
ইহুদিদের অনুপ্রবেশকে স্বাভাবিকরণ
আল-আকসায় ইসরায়েল ইহুদিদের প্রবেশ স্বাভাবিকরণ শুরু করে। শুরুতে তারা নির্দিষ্ট কিছু দিনে যেত। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে এই অনুপ্রবেশ প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এখন ইহুদিদের একটি দল ফজরের নামাজের পর সকালে আল-আকসা আসে। আরেকটি দল জোহরের নামাজের পর আল-আকসা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে। ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ, এভাবে ধীরে ধীরে আল-আকসাকে ইহুদিদের প্রার্থনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এরমাধ্যমে মূলত মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিদেরও প্রার্থনাস্থল বানানো হচ্ছে এটি।
এরমধ্যে ২০২১ সালের মে মাসে, পবিত্র রমজান মাসের সময় আল-আকসায় ইসরায়েলি বাহিনীর অনুপ্রবেশ ইসলামিক ধর্মীয় আচার-আচরণে ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে পুরো ফিলিস্তিনজুড়ে ১১ দিনের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া দখলদার ইসরায়েলের সেনাদের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধও শুরু হয়ে যায়।
এর দুই বছর পর ২০২৩ সালে ইসরায়েলের বিভিন্ন অবৈধ বসতিতে হামলা চালায় হামাস। তারা জানিয়েছে, ২০২১ সালে ইসরায়েল আল-আকসায় যে তাণ্ডব চালিয়েছিল সেটির জবাবে তারা ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে এ হামলা চালিয়েছে।
উত্তেজনা বৃদ্ধি
হামাস ইসরায়েলে ৭ অক্টোবর ওই অতর্কিত হামলা চালানোর পর প্রথম শুক্রবার ছিল ১৩ অক্টোবর। ওইদিন ইসরায়েল ৬০ বছরের কম বয়সী কাউকে আল-আকসা মসজিদে প্রবেশ করতে দেয়নি। শত শত ইসরায়েলি অফিসার পুরনো শহর এবং মসজিদের প্রবেশপথগুলোতে মোতায়েন ছিল। যেসব তরুণ মসজিদে প্রবেশের চেষ্টা করছিল তাদের ওপর ওইদিন সহিংস দমন-পীড়ন চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ আশেপাশের রাস্তায় নামাজ পড়তে বাধ্য হয়।
ওইদিন থেকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এবং কথিত টেম্পল মাউন্ট গোষ্ঠীগুলো আল-আকসা মসজিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে। এই কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ফিলিস্তিনিদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা।
এই বিধিনিষেধগুলোর মধ্যে রয়েছে পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞা ও সীমাবদ্ধতা। অনেক ক্ষেত্রে, ৫০ বছরের কম বয়সী পুরুষদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এছাড়াও, ইসরায়েলি বাহিনী প্রতি বছর জেরুজালেম বা ইসরায়েলের ভেতরের ফিলিস্তিনিদের ওপর অসংখ্য ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
যে মসজিদে একসময় লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ পড়ত এবং প্রতি শুক্রবার হাজার হাজার মুসল্লি আসত, এখন সেখানে শুক্রবার মাত্র কয়েক হাজার এবং প্রতিদিন মাত্র কয়েকশো মুসল্লি উপস্থিত হয়।
প্রকাশ্যে ইহুদিদের প্রার্থনা
একদিকে মুসলিমদের তাদের নিজেদের মসজিদে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইসরায়েল ইহুদিদের অনুপ্রবেশ বাড়িয়েছে। এমনকি তারা প্রকাশ্যে প্রার্থনা শুরু করে। ২০২৪ সালে ৫৬ হাজারের অধিক ইহুদি আল-আকসায় অনুপ্রবেশ করে প্রার্থনা করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রতিটি অনুপ্রবেশের সময়সীমাও বেড়েছে। ইহুদি গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য আল-আকসায় বছরে এক লাখ অনুপ্রবেশ ঘটানো।
সাম্প্রতিক মাসগুলোর সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনা হলো এই অনুপ্রবেশগুলোর সময় প্রকাশ্যে এবং জনসমক্ষে ইহুদিদের প্রার্থনা করা। আগে এই ধরনের প্রার্থনা লুকিয়ে লুকিয়ে করত ইহুদিরা।
দখলদার ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গিভির চুক্তির লঙ্খন করে ইহুদিদের প্রকাশ্যে প্রার্থনা করতে বলেছেন। এরপর এটি বহুলাংশে বেড়ে যায়। বেন গিভির নিজেও আল-আকসায় গিয়ে প্রকাশ্যে প্রার্থনা করেছেন।
চলতি বছরের জুনে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে দোহাই দিয়ে কয়েকদিনের জন্য আল-আকসা মসজিদ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় দখলদার ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের মতে, এর আসল উদ্দেশ্য ছিল মসজিদের ওপর ইসরায়েলি "সার্বভৌমত্ব" প্রতিষ্ঠা করা। এটি প্রমাণ করে যে ইসরায়েল যখন ইচ্ছা তখন এটি খুলতে ও বন্ধ করতে পারে।
তৃতীয় মন্দির
আল-আকসা মসজিদের ওপর ইসরায়েলের প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এছাড়া চুক্তিটিও আর কার্যকর নেই। প্রশ্ন হলো এখন কী হবে?
২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে ইসরায়েলি এমপি অমিত হালেভি আল-আকসা মসজিদকে ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করার একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন। হালেভি পরামর্শ দেন, কমপ্লেক্সের দক্ষিণের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ করা হবে, এবং বাকি অংশ, যার মধ্যে ডোম অব দ্য রক রয়েছে, তা ইহুদিদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
এক বছর পর, বেন গিভির এই ধারণার প্রতি সমর্থন জানান। যদিও তিনি স্পষ্ট করে মসজিদকে ভাগ করার কথা বলেননি, তবে তিনি কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি সিনাগগ (ইহুদি প্রার্থণাস্থল) নির্মাণের পক্ষে তার সমর্থন জানান।
আল-আকসা মসজিদ ধ্বংস করে তৃতীয় ইহুদি মন্দির নির্মাণের আহ্বান দীর্ঘদিন ধরে করে আসছিল কিছু উগ্র সংগঠন। তারা দিনে দিনে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
গত মে মাসে, ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজায়েল স্মোরিচ কথিত “জেরুজালেম দিবস” সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় বলেন, তারা "ইসরায়েলি সীমান্ত প্রসারিত করবেন এবং আল-আকসায় তৃতীয় মন্দির পুনর্নির্মাণ করবেন।”
ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা, আল-আকসা দখলের লক্ষ্য নিয়ে প্রথমে এটির ভেতর একটি সিনাগগ তৈরি করবে। এরপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। হেবরনের ইব্রাহিমি মসজিদের ক্ষেত্রেও তারা একই কাজ করেছে।
ইসলামি ওয়াকফের একটি সূত্র বলেছেন, “আল-আকসা মসজিদে যা ঘটছে তা শুধু কিছু সাময়িক লঙ্ঘনের ঘটনা নয়। এটি একটি ব্যাপক ইহুদিকরণ প্রকল্প, যার লক্ষ্য হলো মসজিদের ওপর পূর্ণ ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দেওয়া। ফিলিস্তিনি এবং মুসলিম বিশ্বকে এই চ্যালেঞ্জের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে এবং এমন একটি পরিকল্পনার মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে, যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে, কারণ একবার চাপানো বাস্তবতা অপরিবর্তনীয় হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকবে না।" সূত্র: মিডেল ইস্ট আই
এসএন/রুপা
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: