হিরোশিমা ট্র্যাজেডির ৮০ বছর, কী ঘটেছিল সেদিন
প্রকাশিত:
৬ আগস্ট ২০২৫ ১২:১৫
আপডেট:
৬ আগস্ট ২০২৫ ১৪:২৯

জাপানের হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ নামের আগুন নেমে এসেছিল ঠিক ৮০ বছর আগে, ১৯৪৫ সালের আজকের দিনে। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে আছড়ে পড়া পারমাণবিক বোমায় মুহূর্তে ধ্বংস হয় একটি শহর। প্রাণ হারান ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ।
বছর শেষে নিহতের সংখ্যা ছাপিয়ে যায় ১ লাখ ৪০ হাজার। কিন্তু যারা বেঁচে ফিরেছিলেন, তারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সেই আগুনের ক্ষত-চামড়ায় নয়, হৃদয়ে। সময় গড়িয়েছে, কিন্তু দুঃস্বপ্ন থামেনি।
আগস্ট এলেই আবারও দগদগে হয়ে ওঠে সেই ক্ষত। হিরোশিমা শুধু ইতিহাস নয়, বেঁচে থাকার এক অনস্বীকার্য যন্ত্রণাও।
কালের সাক্ষী তোমোদা
হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের কেন্দ্র (হাইপোসেন্টার) থেকে ৫০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের মধ্যে আজ শুধু একজনই বেঁচে আছেন। ওসাকা প্রদেশের কাদোমা শহরের ৮৯ বছর বয়সি তসুনেহিরো তোমোদা। কালের সাক্ষী হয়ে এখনো বেঁচে আছেন তিনি।
হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে চলা গবেষণা তথ্যানুসারে, যারা হাইপোসেন্টারের ৫০০ মিটার বা তার কাছাকাছি ছিলেন তাদের মৃত্যুহার প্রায় ১০০ শতাংশ বলে ধারণা করা হয়।
১৯৬০-এর দশকে হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সংস্থা শহরের ওই এলাকার বাসিন্দাদের খুঁজে বের করার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ করেছিল। ৭৮ জনের বেঁচে থাকার তথ্য নিশ্চিত হয়। এদের মধ্যে ৪৯ জন পুরুষ ও ২৯ জন নারী ছিলেন। বিস্ফোরণের সময় তাদের বয়স ছিল মাত্র ৫ মাস থেকে ৫৪ বছর পর্যন্ত।
১৯৭২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রতি দুই বছর অন্তর ওই বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আসছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে ক্যানসারের সংক্রমণ।
২০ বছরের কম বয়সে যারা পারমাণবিক বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে আক্রান্তের হার ছিল ৪২ শতাংশ, এবং ৪০ বা তার বেশি বয়সিদের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন।
সেদিনটা ভাবতেও চাই না
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের দুদিন পর বাবাকে খুঁজতে শহরে ঢুকেছিলেন ১০ বছর বয়সি ইয়োশিকো নিয়ামা। আগুন তখনো জ্বলছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল লাশ।
২০২৫ সালে হিরোশিমা পারমাণবিক হামলার ৮০ বছর পূর্তিতে ৯০ বছর বয়সি নিয়ামা হচ্ছেন হাতেগোনা কয়েকজন জীবিতদের একজন। যারা এখনো সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি বহন করছেন।
স্মৃতিচারণায় নিয়ামা বলেছেন, ‘বেঁচে থাকা অনেকের মুখ এমন বিকৃত হয়েছিল যে তাকানোর সাহস হতো না। তবুও তাকাতে হচ্ছিল।’ সেই ভয়াল স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাকে। তিনি বলেছেন, আমি সেদিনটা ভাবতেও চাই না। নিয়ামা ও তার বড় বোন তাদের বাবাকে খুঁজতে শহরে ঢুকেছিল। তাদের বাবা মিতসুগি, শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র ১ কিমি দূরত্বে এক ব্যাংকে কাজ করতেন। যুদ্ধের সময় নিয়ামা ও তার পরিবার শহরের বাইরে এক আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। কিন্তু ফিরে এসে তাদের বাবাকে আর খুঁজে পায়নি তারা।
নিয়ামা বলেছেন, ‘বাবা ছিলেন লম্বা মানুষ। তাই অনেক বছর পরও কোনো লম্বা মানুষ দেখলেই আমি দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ডাকতাম, যদি উনিই হন। কিন্তু কখনোই তিনি ছিলেন না।’ অনেক বছর ধরে নিয়ামা তার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে কাউকে কিছু বলেননি। না পরিবারকে, না বাইরে। ভেবেছিলাম ভুলে থাকাই ভালো, বললেন নিয়ামা। অনেকে চুপ ছিলেন কারণ তারা ভয়ে ছিলেন-হয়তো বিয়ে হবে না, চাকরি পাওয়া যাবে না। কারণ গুজব ছিল, হিবাকুশাদের (ভুক্তভোগীদের) সন্তানদের বিকলাঙ্গতা হতে পারে।
অপবাদ-অবহেলায় বন্দি জীবন
শিম জিন-টায়ে। হিরোশিমার ভয়াবহ পরমাণু বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে ফিরে আসা অন্যতম জীবিত সাক্ষী। যখন যুক্তরাষ্ট্র ‘লিটল বয়’ নামক পারমাণবিক বোমাটি হিরোশিমার ওপর ফেলে, তখন শহরের আনুমানিক ১,৪০,০০০ কোরিয়ান বাসিন্দার মতো তিনিও সেখানেই ছিলেন।
সেসময় অনেক কোরিয়ান জাপানি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত ছিলেন। শিমের বাবা গোলাবারুদের কারখানায় এবং মা গোলাবারুদের বাক্সে পেরেক ঠুকার কাজ করতেন। বেঁচে যাওয়া কোরিয়ানদের সাক্ষ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিস্ফোরণের পর কোরিয়ান শ্রমিকদের দিয়ে লাশ পরিষ্কারের কাজ করানো হতো।
প্রথমে স্ট্রেচার, পরে ধুলো ঝাড়ার ফালি ব্যবহার করে লাশগুলো স্কুল প্রাঙ্গণে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যাক্ষদর্শীরা। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরলেও শিম ও অন্যান্য হিবাকুশারা সামাজিক অপবাদ, গোঁড়ামি ও অবহেলার শিকার হন।
শিম তীব্র ক্ষোভ ঝেড়ে বলেছেন, ‘জাপান দায় নেয়নি, আমেরিকা ক্ষমা চায়নি, আর কোরিয়া আমাদের ভুলে গেছে।’ শিম জিন-টায়ে শুধু একজন জীবিত সাক্ষী নন, তিনি হয়ে উঠেছেন যুদ্ধোত্তর অবহেলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।
বর্তমানে তিনি কোরিয়ান পারমাণবিক বোমা ভুক্তভোগী সমিতির হ্যাপচন শাখার পরিচালক। হ্যাপচনের যেসব পরিবার হিরোশিমা থেকে ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকেই আজও দারিদ্র্য, রোগ ও সামাজিক বৈষম্যের চক্রে বন্দি।
বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: