দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ গাজার ২১ লাখ বাসিন্দা
প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২৫ ১৫:২১
আপডেট:
১৩ মে ২০২৫ ১৬:৫১

যুদ্ধবিধ্বস্ত মজলুমদের জনপদ গাজায় বসবাসরত প্রায় ২১ লাখ ফিলিস্তিনি মানুষ দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’ রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়ন বিষয়ক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)। খবর বিবিসি বাংলা।
দখলদার ইসরাইলের অব্যাহত অবরোধের মুখে ত্রাণ ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা ঢুকতে না পারার কারণে সেখানকার বাসিন্দারা ‘চরম খাদ্য সংকটের’ মুখোমুখি হচ্ছেন বলেও এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি মূলত জাতিসংঘ, দাতা সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি সংস্থা, যাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহল একটি এলাকায় দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে কি-না, সেটির প্রাথমিক মূল্যায়ন করে থাকে।
সোমবার প্রকাশিত আইপিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে পর থেকেই গাজার খাদ্য পরিস্থিতিতে ‘বড় ধরনের অবনতি’ ঘটেছে। বর্তমানে সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু না হলেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে যে, ইসরাইল এবং হামাসের দুই মাসের যুদ্ধবিরতিতে গাজায় সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে নতুন করে যে বৈরিতা দেখা যাচ্ছে, সেটি গাজাবাসীকে পুনরায় উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
বিশেষ করে, গত মার্চের শুরু থেকে মানবিক সহায়তা প্রবেশে ইসরাইলের অব্যাহত বাধা পরিস্থিতিতে আরও জটিল করে তুলেছে।
প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, বর্তমানে গাজার প্রায় দুই লাখ ৪৪ হাজার মানুষ 'তীব্র' খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখিন হচ্ছেন। এ অবস্থায় দুর্ভিক্ষের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আইপিসি।
গত মার্চ মাসের মধ্যভাগ থেকে গাজায় আবারও অভিযান শুরু করে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। এরপর গত দুই মাস ধরে সেখানে খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
ইসরাইল বলছে, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে এখনো যেসব নাগরিক জিম্মি রয়েছে, তাদেরকে মুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই তারা এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল ইসরাইলের এই অব্যাহত অবরোধের বিরোধিতা করে নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘ বলেছে, গাজা সীমান্ত তারা ইতিমধ্যেই মানবিক সহায়তা সামগ্রী প্রস্তুত রেখেছে। ইসরাইল বাধা না দিলেই সেগুলো দ্রুত ঢুকে যেতে পারবে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানাচ্ছে ত্রাণ সহায়তার ওপর ইসরাইলের অব্যাহত এই অবরোধ এবং গাজাবাসীকে ‘অনাহারে রাখার নীতি’ যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।
আইপিসি প্রকাশিত সবশেষ মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, গাজার প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ অনাহারের মুখোমুখি হচ্ছে।
২০২৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১১ মাসে সেখানকার পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৭১ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়ন বিষয়ক সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যাভাবের কারণে গাজার অনেক পরিবার বিভিন্ন ধরনের চরম পদক্ষেপও নিচ্ছে। কেউ কেউ ভিক্ষা করা শুরু করেছে, অনেকে ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানায়, অক্টোবরের তুলনায় পরিস্থিতির এই অবনতি বিশ্বব্যাপী সংঘাতে ঘেরা অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের প্রতিফলন।
এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ১.৯৫ মিলিয়ন (১৯ লাখ ৫০ হাজার) মানুষ, অথবা গাজার জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চ স্তরের মধ্য দিয়ে বাস করছে, যার মধ্যে দুই লাখ ৪৪ হাজার জন বিপর্যয়কর স্তরের সম্মুখীন হচ্ছে।
ইসরাইলি কর্মকর্তারা অবশ্য গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার বিষয়টি মানতে নারাজ। তারা দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতির সময় সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশ করেছে।
এদিকে, হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে- গাজায় খাবার, ওষুধসহ অন্যান্য মানবিক সহায়তা যেন ঢুকতে দেওয়া হয় সেজন্য তারা ইসরাইলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
সোমবার এডান আলেক্সান্ডার নামে আমেরিকান-ইসরাইলি নাগরিক একজন জিম্মিকে মুক্তিও দিয়েছে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
তাকে গাজায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের হাতে তুলে দেয় তারা। প্রায় ৫৮০ দিন হামাসের হাতে জিম্মি থাকার পর নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন আলেক্সান্ডার।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেয়নি। আলেকজান্ডারের মুক্তির পরিবর্তে তারা কেবল একটি নিরাপদ করিডোর দেওয়া কথা ভাবছে বলেও জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার মধ্যপ্রাচ্যে সফরে গেছেন। ট্রাম্পের এই সফরকালে কোনো চুক্তিতে না পৌঁছালে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল।
ইসরাইলের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের বর্ধিত আক্রমণ পরিকল্পনার মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার সব এলাকা দখল করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া গাজাবাসীকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে দক্ষিণে পাঠানোর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে নেবে ইসরাইল।
যদিও জাতিসংঘ সহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা ইসরাইলের এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে যে, এটি বাস্তবায়ন হলে মানবিক সহায়তা সামগ্রীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ইসরাইল।
২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলায় প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হয়। এছাড়া ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
গত দেড় বছরে জিম্মি ইসরাইলি নাগরিকদের অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন। তবে এখনো প্রায় ৫৯ জন জিম্মি হামাসের হাতে জিম্মি রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জনের মতো জীবিত রয়েছেন।গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, সাতই অক্টোবরের ঘটনার পর ইসরাইল যে সামরিক অভিযান শুরু করেছে, তাতে গাজার অন্তত ৫২ হাজার ৮৬২ জন বাসিন্দা নিহত হয়েছে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: