খোরপোশের কৃষি বনাম বাণিজ্যিক কৃষি
প্রকাশিত:
৩১ জুলাই ২০২৫ ১৭:৫০
আপডেট:
১ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৩৬

কৃষি একটি শ্রমঘন পেশা। এ কারণে বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো ক্রমশ কৃষি ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করতো। কৃষকের ছেলে কৃষক হতে চাইতো না। চাকরি বা ব্যবসাসহ ভিন্ন পেশায় মনোনিবেশ করতো। কৃষকও নিজেও চাইতেন না নিজের সন্তানকে কৃষি পেশায় নিয়ে আসতে। অনেক ক্ষেত্রে পেশা হিসেবে কৃষির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও কম সম্মানের বিষয়টি বিবেচ্য ছিল। কিন্তু দিন বদলের পালায় সেই গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। কেননা কৃষি এখন প্রযুক্তিবান্ধব ও আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক লাভজনক পেশা। কৃষিই সমৃদ্ধি এটা আবারও আমাদের সচেতন সমাজ উপলব্ধি করছেন। এটা ঠিক যে বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এক সময় কৃষি ছিল মূলত খোরপোশের চাহিদা মেটানোর মাধ্যম। কৃষকরা নিজ পরিবারের খাদ্যসংস্থান নিশ্চিত করতেই কৃষিকাজ করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চিত্র বদলে গেছে। এখন কৃষি শুধু পেটের দায় নয়, এটি হয়ে উঠেছে মুনাফাভিত্তিক ও বাজারমুখী বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড।
খোরপোশের কৃষি মূলত কৃষক ও তার পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য করা হতো, যেখানে জমির পরিমাণ যেমন কম ছিল তেমনি প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল সীমিত। খোরপোশের কৃষিতে কৃষক প্রধানত নিজের ও পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য ফসল উৎপাদন করতেন। এটি একটি প্রাচীন ও প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা যা এখনো বাংলাদেশের গ্রামীণ অনেক এলাকায় বিদ্যমান। এই ধরনের কৃষিতে সাধারণত পরিবারভিত্তিক শ্রম ব্যবহৃত হয়, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত থাকে এবং উৎপাদিত ফসল বা পণ্য বাজারে বিক্রির জন্য নয়, বরং নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়।
অন্যদিকে, বাণিজ্যিক কৃষি হলো মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে অধিক জমি ব্যবহার করে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষিত তরুণেরা বাণিজ্যিক কৃষিতে ঝুঁকছেন কেননা বাণিজ্যিক কৃষি এখন মূলত আগের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও লাভজনক। বাজারে ফসল বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বাণিজ্যিক কৃষিকে সামাজিকভাবে এখন বেশ সম্মানের চোখেই দেখা হয়। মোদ্দাকথা হলো, শিল্পায়নের যুগে প্রাচীন কৃষি পদ্ধতি এখন আর টেকসই নয়। কৃষিকে জনপ্রিয় ও লাভজনক করতে খোরপোশের কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে।
বাণিজ্যিক কৃষিতে বৃহৎ আকারের যে জমি ব্যবহৃত হয় যেটাকে আমরা খামার বলে থাকি। সেই খামারে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট ফসলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় (যেমন ফুল, ফল, সবজি, মাছ, ব্রয়লার ইত্যাদি)। কেবল ফসল উৎপাদন নয়, কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকে ফসলের প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং, বিপণন ও রপ্তানির বিষয়াদির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশে এখনো অধিকাংশ কৃষক খোরপোশের কৃষিতে নিয়োজিত থাকলেও কয়েক দশকে বাণিজ্যিক কৃষির প্রসার ঘটেছে। শাকসবজি, পোলট্রি, মাছচাষ, ফুলচাষ, ফলচাষ এমনকি অর্গানিক ফসল চাষ এখন বাণিজ্যিক কৃষির আওতায় এসেছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। তবে এই রূপান্তরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। খোরপোশের কৃষকদের অনেকেই মূলধন, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অভাবে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর ঘটাতে পারছেন না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাজারজাতকরণের সমস্যাসহ অনেক প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই।
দেশে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ মনমতো কাজ পান না। তারা পড়াশোনা করেন না, কাজেও নেই। তারা ছদ্মবেকার। কোনো রকম জীবনধারণের জন্য কাজ করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ এবং প্রতিবছর নতুন করে ৪-৫ লাখ তরুণ এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। অথচ সেই তুলনায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে খুবই সীমিত পরিসরে। এই বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে সবার জন্য একযোগে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এখনই সম্ভব নয়। তবে সরকার চাইলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে তাদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। যদিও এই সংকট মোকাবিলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে বাস্তবে তা যথেষ্ট নয়। আমরা এখন জনসংখ্যার বোনাস পর্যায়ে রয়েছি, অর্থাৎ দেশের কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এই জনমিতিক সুযোগের স্থায়িত্ব থাকবে প্রায় ৩০-৪০ বছর। ফলে এখনই উপযুক্ত সময়, বিকল্প ও টেকসই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করার। এ প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক কৃষি হতে পারে এক বিশাল কর্মক্ষেত্রের টেকসই প্ল্যাটফর্ম।
বর্তমানে কৃষিতো শুধু হালের কোদাল-লাঙলের চাষ নয়, এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খাত। একজন শিক্ষিত তরুণ যদি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও চাষাবাদ সম্পর্কে অল্প সময়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে তাহলে সঠিক পরিকল্পনা, আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকলে অল্প পুঁজিতে প্রতি মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় করতে পারে। যা ছোটখাটো চাকরির চেয়ে অনেক বেশি টেকসই ও সম্মানের। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ সবসময় তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশে আছে। প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে কৃষি অফিস, যেখানে অঞ্চলভিত্তিক লাভজনক ফসল বা চাষাবাদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়।
বহির্বিশ্বের ন্যায় দেশের কৃষিতেও এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার। মৌসুমভিত্তিক চাষাবাদের ধারণা বদলে গিয়ে কিছু কিছু ফল ফসল এখন সারা বছরই উৎপাদিত হচ্ছে। বছরব্যাপী উৎপাদনের কারণে ন্যায্য দামও পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। দেশি ফলমূলের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন সফলভাবে চাষ হচ্ছে থাই পেয়ারা, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো, কিউই, রাম্বুটানসহ নানা বিদেশি ফল। এই পরিবর্তনের হাত ধরে গড়ে উঠছে এক নতুন কৃষি উদ্যোক্তা শ্রেণি যাদের বড় অংশই শিক্ষিত তরুণ। তাদের হাতে কৃষি এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, বিপণন কৌশল ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
তবে, আশার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। এখনো কৃষি উদ্যোক্তার সংখ্যা দেশের চাহিদা অনুযায়ী খুব বেশি নয়। অনেক তরুণের মাঝেই রয়েছে সম্ভাবনা, কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা, পুঁজি, প্রশিক্ষণ ও নীতিগত সহায়তার অভাবে তারা কৃষিতে আসতে পারছে না। আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশের টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য দুই ধরনের কৃষির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। খোরপোশের কৃষকদের জন্য উন্নত বীজ, প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে তারা বাণিজ্যিক কৃষির দিকে অগ্রসর হতে পারবেন। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এটি ঠিক যে, খোরপোশ কৃষি থেকে আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কৃষি বিজ্ঞানী, গবেষক, সম্প্রসারণবিদ ও কৃষিনীতি প্রণেতাগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজটি করে থাকেন দেশের অসংখ্য ছোট বড় কৃষি উদ্যোক্তা, যারা কষ্টার্জিত পুঁজি সংস্থান করে ও ঝুঁকি নিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির সমাহার ঘটিয়ে বিনিয়োগ করে থাকেন। সরকারের উচিত এসব উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পুঁজি ও উৎপাদিত ফসল ও পণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা।
আমরা বর্তমানে কৃষির এক সম্ভাবনাময় ও ‘সুবর্ণ সময়ের’ দিকে এগিয়ে চলেছি-যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং উদ্ভাবনী চাষাবাদ দেশের কৃষিকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে পারে। এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ, যাতে কৃষির এই ইতিবাচক ধারা টেকসই হয় এবং আরও তরুণ এই খাতে যুক্ত হয়। সর্বোপরি, কৃষিকে শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদনের উৎস নয় বরং একটি লাভজনক, সম্মানজনক ও পরিবেশবান্ধব পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেশের কৃষির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ড. এম আব্দুল মোমিন : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি)
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: