বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণ নিরসনে প্রযুক্তি ও আমাদের অবস্থান
প্রকাশিত:
১৯ জুলাই ২০২৫ ১০:৪৫
আপডেট:
১৯ জুলাই ২০২৫ ১৬:২৩

বায়ু দূষণ এখন নীরব বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে, যা ২০২১ সালে প্রায় ৮.১ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৃত্যুঝুঁকির কারণ, বলে জানিয়েছে State of Global Air 2024 প্রতিবেদনে।
হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (HEI), ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (IHME) এবং ইউনিসেফ-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষ এমন বায়ু শ্বাস নিচ্ছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নিরাপদ মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি দূষিত।
এই বিষাক্ত বায়ু শ্বাস নেওয়া বহু ধরনের অসংক্রামক রোগের কারণ, যেমন হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, ফুসফুস ক্যান্সার এবং অকাল প্রসব বা কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুদের জটিলতা। শিশুদের জন্য এই বিপদ আরও গুরুতর; ২০২১ সালে, ৫ বছরের নিচের ৭ লক্ষাধিক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে বায়ু দূষণের কারণে, যা অপুষ্টির পরেই মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে স্থান পেয়েছে।
এই সংকটের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে PM2.5 নামক অতি সূক্ষ্ম কণিকা, যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের কম। এই কণিকাগুলো ফুসফুসের গভীরে ঢুকে রক্তপ্রবাহে মিশে গিয়ে একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি করে। World Air Quality Report 2024 অনুযায়ী, মাত্র অল্প কয়েকটি দেশই WHO-এর নির্ধারিত বার্ষিক PM2.5 মান (৫ µg/m³) পূরণ করতে পেরেছে।
দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) ও আফ্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। আফ্রিকায়, বায়ু দূষণ বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ, যেখানে ঘরোয়া এবং বাইরের উভয় ধরণের দূষণই ভূমিকা রাখছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই নানাবিধ উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও কৌশলের মাধ্যমে বায়ু দূষণ হ্রাসে বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই উদাহরণগুলো আমাদের দেখায় যে কার্যকর সমাধান বিদ্যমান—প্রয়োজন কেবল দ্রুত ও পরিকল্পিত বাস্তবায়নের।
নরওয়ে পরিবহন খাতে দূষণ রোধে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ২০২৪ সাল নাগাদ দেশটিতে বিক্রি হওয়া নতুন গাড়ির ৮০ শতাংশের বেশি ছিল বৈদ্যুতিক। সরকার বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের জন্য করছাড়, চার্জিং স্টেশন ও বিনামূল্যে পার্কিং সুবিধা প্রদান করেছে। এর ফলে অসলোসহ বড় শহরগুলোয় নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) ও PM2.5 এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। নরওয়ের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, সবুজ পরিবহণে বিনিয়োগ দ্রুত ফলদায়ী হতে পারে।
জ্বালানি খাতে আইসল্যান্ড এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দেশটি প্রায় ১০০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভূতাত্ত্বিক ও জলবিদ্যুৎ উৎস থেকে, যা প্রায় শূন্য বায়ু দূষণ ঘটায়। তাছাড়া, অধিকাংশ বাড়িঘর ভূগর্ভস্থ তাপ ব্যবহার করে গরম করা হয়, ফলে কাঠ, কয়লা বা কেরোসিন পোড়ানোর প্রয়োজন হয় না। এভাবে দেশটি ইনডোর ও আউটডোর—উভয় ক্ষেত্রেই পরিচ্ছন্ন বায়ু নিশ্চিত করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি দিল্লি, যেখানে পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করা হয়েছে 'স্মোগ টাওয়ার' বা বিশাল আকারের বায়ু পরিশোধক। এই টাওয়ারগুলো HEPA ফিল্টার ও আয়ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূক্ষ্ম কণাগুলো (PM2.5) শোষণ করে। যদিও এর প্রভাব বিস্তারের পরিধি এখনো বিতর্কের বিষয়, তবে এটি শহুরে দূষণের বিরুদ্ধে প্রযুক্তিনির্ভর সাহসী পদক্ষেপের প্রতীক।
চীন বৃহত্তম পরিসরে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বৈদ্যুতিক করেছে। শেনজেন শহর সম্পূর্ণরূপে বৈদ্যুতিক বাস ও ট্যাক্সিতে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশজুড়ে প্রায় ৪ লাখের বেশি বৈদ্যুতিক বাস চালু হয়েছে, যার ফলে শহরের NOx ও PM2.5 মাত্রা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনায় বৃহৎ পরিসরে রূপান্তর সম্ভব।
অনুন্নত অঞ্চলে যেখানে গৃহস্থালি দূষণ একটি বড় সমস্যা, সেখানে পরিচ্ছন্ন রান্নার উদ্যোগ জীবনরক্ষাকারী ভূমিকা পালন করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা (Pradhan Mantri Ujjwala Yojana-PMUY) কর্মসূচির মাধ্যমে ৯ কোটিরও বেশি পরিবারকে বিনামূল্যে এলপিজি সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে রুয়ান্ডায় সরকার উন্নত চুলা ও বায়োগ্যাস-ভিত্তিক রান্নার বিকল্প প্রচার করছে। এসব উদ্যোগ নারীদের ও শিশুদের ইনডোর বায়ু দূষণের ক্ষতি থেকে বাঁচাচ্ছে এবং শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া জাতীয় রোগ প্রতিরোধ করছে।
সিঙ্গাপুর দেখিয়েছে কীভাবে নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ু বিশুদ্ধ রাখা যায়। ‘City in a Garden’ ধারণার মাধ্যমে তারা শহরের ভেতরে সবুজ ছাদ, উলম্ব উদ্যান ও ছায়াদানকারী বৃক্ষের সমন্বয়ে একটি সক্রিয় ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে। এগুলো বাতাসে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও সূক্ষ্ম ধূলিকণা শোষণ করে, শহরের উষ্ণতা ও দূষণ দুই-ই কমায়।
লন্ডন শহর প্রযুক্তি ও নীতির মেলবন্ধনে কাজ করছে। শহরজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে বাস্তবসম্মত বায়ু পরিমাপক সেন্সর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পূর্বাভাস ব্যবস্থা। এ তথ্য ব্যবহার করে চালু করা হয়েছে Ultra Low Emission Zone (ULEZ), যেখানে দূষণকারী পুরোনো গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ। এর ফলে NO2 এর মাত্রা প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
জার্মানি দেখিয়েছে কীভাবে উন্নত শিল্প ব্যবস্থাপনায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তারা শিল্প স্থাপনায় কঠোর নির্গমন নীতিমালা আরোপ করেছে এবং ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রিসিপিটেটর ও স্ক্রাবার-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা সালফার-ডাই-অক্সাইড ও সূক্ষ্ম কণাগুলো ধরা ও নিরপেক্ষ করতে সক্ষম।
এই বৈশ্বিক উদাহরণগুলো আমাদের শিখিয়ে দেয়, বায়ু দূষণ রোধে কার্যকর প্রযুক্তি ও কৌশল ইতিমধ্যেই বিদ্যমান। নরওয়ের ইলেকট্রিক গাড়ি, রুয়ান্ডার পরিচ্ছন্ন রান্না, সিঙ্গাপুরের সবুজ নগর পরিকল্পনা কিংবা জার্মানির শিল্প নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ—সবই আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত।
চ্যালেঞ্জটা প্রযুক্তির অভাবে নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দ্রুত বাস্তবায়নের অভাবে। যদি আরও দেশ এগিয়ে আসে এবং এই প্রমাণিত কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করে, তবে বায়ু দূষণ নামের এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জয়ী হতে পারব।
বায়ু দূষণ মোকাবিলায় যে প্রযুক্তি ও কৌশলগুলো বাস্তবে সফল হয়েছে, সেগুলোর ব্যবহারিকতা অনেকাংশেই প্রমাণিত। তবে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। উদাহরণস্বরূপ, বৈদ্যুতিক যানবাহন শহুরে দূষণ কমাতে কার্যকর হলেও উচ্চমূল্য, চার্জিং অবকাঠামোর অভাব এবং বিদ্যুতের উৎস (যদি তা কয়লা হয়) এর পরিবেশগত সুবিধাকে খর্ব করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মাণ ব্যয়বহুল এবং অনেক দেশে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ নেই।
স্মোগ টাওয়ারের মতো প্রযুক্তি প্রতীকী হলেও শহরের মোট দূষণ হ্রাসে কার্যকর নয়। গণপরিবহন বৈদ্যুতিকীকরণ কার্যকর হলেও এতে প্রয়োজন বিশাল বিনিয়োগ ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎব্যবস্থা। পরিচ্ছন্ন রান্নার উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু বহু পরিবার এলপিজির ক্রমাগত খরচ বহন করতে অক্ষম, এবং সংস্কারগত বাধাও রয়েছে।
সবুজ নগর পরিকল্পনা টেকসই হলেও এটি স্থান ও সময়সাপেক্ষ। রিয়েল-টাইম বায়ু পরিমাপক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নীতিনির্ধারণ কার্যকর হলেও এগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ। শিল্প নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিগুলো কার্যকর হলেও তা ছোট শিল্পের পক্ষে ব্যয়বহুল এবং দুর্বল তদারকির কারণে অনেক সময় কার্যকর হয় না।
এই সব প্রযুক্তি ব্যবহারযোগ্য এবং পরীক্ষিত হলেও, অর্থনৈতিক, সামাজিক, কারিগরি ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে এগুলোর সর্বজনীন প্রয়োগ সম্ভব হয় না। তাই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে গৃহীত যেকোনো কৌশলকে প্রায় সর্বজনীন প্রেক্ষিত নির্ভর হতে হবে, যেখানে প্রযুক্তির পাশাপাশি শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা, জনসম্পৃক্ততা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয় থাকতে হবে, যাতে কৌশলসমূহ কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গতভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। তা না হলে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে এই বায়ু দূষণের ঊর্ধ্বমুখিতা প্রশমিত করার কোনো আশা থাকবে না।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এসএন /সীমা
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: