ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে সিরিয়া?
প্রকাশিত:
১ জুলাই ২০২৫ ১৯:৫৮
আপডেট:
২ জুলাই ২০২৫ ০০:০৩

সিরিয়ায় প্রায় ১৪ বছরের যুদ্ধ শেষের পর দেশটির নতুন সরকার তাদের আঞ্চলিক সম্পর্ক পুনর্গঠন করছে। আর এই সম্পর্ক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সিরিয়ার সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে কী করতে যাচ্ছে অনেকের দৃষ্টি এখন সেদিকে।
বেশ কিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা চলছে। এমনকি দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের একটি সময়সীমাও আলোচনায় এসেছে। যদিও ১৯৪৮ সালের আরব‑ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে উভয় দেশই কৌশলগত দিক থেকে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।
সিরিয়া এবং ইসরায়েল সম্ভাব্য সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ সম্পর্কে যা জানা দরকার :
১. এখন পর্যন্ত কী ঘটেছে?
ইসরায়েলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মাঝে ইতোমধ্যে সরাসরি আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের এই আলোচনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত সহায়তা করেছে।
তবে দুই দেশের মাঝে যে কোনও ধরনের চুক্তি হলে তা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাক্ষরিত অ্যাব্রাহাম চুক্তিরই সম্প্রসারণ হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই অ্যাব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
২০২০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরে সুদান ও মরক্কোও একই পথে হাঁটে। ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোকে রাজি করাতে তখন থেকে কাজ করে যাচ্ছেন ট্রাম্প।
গত মে মাসে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সময় সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল‑শারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। ওই সাক্ষাতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সিরিয়ার নেতাকে উৎসাহ দেন ট্রাম্প।
২. সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ কি সম্ভব?
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি ভবিষ্যতে হয়তো সম্ভব হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে তা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন সিরীয় লেখক রবিন ইয়াসিন‑কাসাব।
সিরিয়া এবং ইসরায়েলের মাঝে এখনও ব্যাপক বৈরী সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৬৭ সালের আরব‑ইসরায়েল যুদ্ধ ও গোলান মালভূমি দখলের সময় সম্পর্কের এই বৈরীতা প্রকট আকার ধারণ করে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিডিওন সার বলেছেন, সিরিয়ার সঙ্গে যেকোনও ধরনের চুক্তি হলে সেখানে গোলান মালভূমির দখল অব্যাহত রাখবে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সৈন্যরা এই মালভূমির ঘরবাড়ি দখল করে লোকজন উচ্ছেদ করেছে। বর্তমানে ইসরায়েলি সৈন্যরা ওই এলাকার আরও ভেতরে প্রবেশ করেছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের কাছে ছেড়ে দেওয়ার বিরোধিতা করবেন অনেক সিরীয়। তবে বাস্তবধর্মী আলোচনাকেও অনেকে স্বাগত জানাতে পারেন।
ইয়াসিন‑কাসাব বলেন, সিরীয়রা বর্তমানে বিভক্ত... অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতে তারা ক্লান্ত। আর প্রত্যেকে এটা স্বীকারও করেন যে, সিরিয়া নিজেকে রক্ষা অথবা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না। যে কারণে (আল‑শারার) আলোচনা করাটাও ভালো। তার মতে, ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতির মতো চুক্তিতে ফিরে যাওয়াই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত হতে পারে।
গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল‑আসাদ দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলের সংসদ সিরিয়ায় বসতি সম্প্রসারণের পক্ষে ভোট দেয়। স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশে আরেকটি দেশের বসতি স্থাপনের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। বর্তমানে দখলকৃত গোলান মালভূমিতে ৩১ হাজারের বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী রয়েছেন।
ক্ষমতায় আসার পর আল‑শারা বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিতে পৌঁছানোর জন্য তার দেশ উন্মুক্ত রয়েছে এবং ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে। কিন্তু গত ৮ ডিসেম্বর আল‑শারা জানিয়েছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিতে তিনি উন্মুক্ত এবং ১৯৭৪‑এর যুদ্ধবিরতি মেনে চলবেন; কিন্তু ৮ ডিসেম্বর আসাদের মস্কোতে পালিয়ে যাওয়ার দিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ওই চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন।
অতীতে বহুবার সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস ও গোলান মালভূমি সংলগ্ন সিরিয়ার ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। চুক্তির আওতায় সিরিয়া ইসরায়েলকে নতুন করে দখলে নেওয়া এলাকা ত্যাগ করার কথা বলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে উভয়পক্ষের মাঝে গোলান মালভূমি নিয়ে এখনও কোনও আলোচনা হয়নি।
৩. সাম্প্রতিক কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
সম্প্রতি ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা সিরিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে প্রস্তুত। আর এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত টম বারাককে আহ্বান জানিয়েছেন নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান জাচি হানেগবি সিরিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার তত্ত্বাবধান করছেন। যুক্তরাষ্ট্রও এই আলোচনায় অংশ নিয়েছে। বর্তমানে চুক্তির এই আলোচনা ব্যাপক অগ্রগতির পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে জানিয়েছেন।
লেবাননের সংবাদমাধ্যম দৈনিক আল‑আখবার বলেছে, আল‑শারার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। যাতে সিরিয়াকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পূর্ণ স্বাভাবিকীকরণের সব শর্ত মানতে না হয়।
৪. ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা থেকে কী চায় সিরিয়া?
সিরিয়া চায় তাদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হোক। অনেক সিরীয় গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের সম্প্রসারণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে আল‑শারার সরকার দখলকৃত অংশ ফেরত চাইবে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়।
যদিও গোলান মালভূমির মূল অংশ ও গত বছর দখল করা এলাকাগুলো থেকে ইসরায়েলের অপসারণ চায় সিরিয়া। সিরিয়ার নতুন সরকারকে রাজধানী দামেস্কের দক্ষিণে সৈন্য মোতায়েন না করার বিষয়ে হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। ওই এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময় ইসরায়েল ‘সিরীয় দ্রুজদের রক্ষার’ অজুহাতে হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে বিভাজন উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
দ্রুজ সম্প্রদায়ের অনেকেই দেশটির নতুন সরকারের প্রতি সন্দেহপোষণ করছেন। অনেকেই ইসরায়েলের হস্তক্ষেপের হুমকিকে সিরীয়দের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির কৌশল বলে আখ্যায়িত করে নিন্দা জানিয়েছেন।
৫. ইসরায়েল কী চায়?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ১৯৭৪ সালের চুক্তিকে হালনাগাদ করে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা চুক্তি ও শান্তি পরিকল্পনার কাঠামো চান। মার্কিন দূত বারাক দাবি করেছেন, সিরিয়া‑ইসরায়েল বিরোধ সমাধানযোগ্য। ইসরায়েলি আগ্রাসন হবে না এমন শর্তের চুক্তি দিয়ে এই আলোচনা শুরু করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব চলতে থাকলে, তা অনেক সিরীয় নাগরিককে ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। ইয়াসিন‑কাসাব বলেন, মার্কিন চাপ ও ইসরায়েলের সহিংসতার হুমকির মাঝে এই চুক্তিতে পৌঁছানো সিরিয়ার ক্ষমতাসীন আল‑শারার জন্য অত্যন্ত কঠিন।
শুধু তাই নয়, এই চুক্তিতে সিরিয়ায় তুরস্কের ঘাঁটি স্থাপন না করা, ইরান কিংবা হিজবুল্লাহর উপস্থিতির বিরুদ্ধে ও দক্ষিণ সিরিয়াকে নিরস্ত্রকরণের শর্ত জুড়ে দিয়েছে ইসরায়েল।
সূত্র: আল জাজিরা।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: