দুই বছরেই কোটিপতি রাজউকের ইমারত পরিদর্শক মলয়!
প্রকাশিত:
২৪ মে ২০২৫ ২১:০৬
আপডেট:
২৫ মে ২০২৫ ০১:২০

২০২৩ সালের ২মে রাজউকে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর মাত্র দুই বছরের ব্যবধানেই হয়েছেন কোটিপতি। কিনেছেন জমি-ফ্ল্যাট, চড়েন দামী গাড়িতে। ভবন নির্মাণকারীদের জিম্মি করে বিপুল অঙ্কের ঘুষ আদায় করে রাতারাতি বিত্তবান হওয়া সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তির নাম মলয় চন্দ্র রায়। বর্তমানে তিনি রাজউকের সাব-জোন ৬/২ এর ইমারত পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজধানীর আমুলিয়া থেকে শুরু করে ডেমরা, দনিয়া, যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, মাতুয়াইল, সারুলিয়া, সিদ্দিরগঞ্জসহ উত্তর দূর্গাপুর পর্যন্ত মোট ৪০টি মৌজা এলাকা (আংশিক/পূর্ণ) রাজউকের সাব-জোন ৬/২ এর আওতাধীন। এই জোনে মোট ১০ জন ইমারত পরিদর্শকের মধ্যে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড় মলয়। বিশেষ কৌশলে খুব সহজেই অন্যের পকেট থেকে লাখ লাখ টাকা বের করে আনতে পারেন নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার উত্তর চেরেঙ্গা গ্রামের মলয় চন্দ্র রায়। সহজ-সরল চেহারার মলয়কে সামনে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই- সে কতটা ধুরন্ধর!
অভিযোগ উঠেছে, রাজউকে ইমারত পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগদানের পর গত দুই বছরে যখন যে এলাকার দায়িত্ব পেয়েছেন- সেখান থেকেই মোটা অংক হাতিয়েছেন মলয়। কথিত আছে- মলয়ের মিটার কখনোই ২ লাখের নিচে নামে না। কোন নির্মাণাধীন ভবনের দিকে তাকালেই কমপক্ষে দুই লাখ টাকা দিতে হবে তাকে। সাইট পরিদর্শনে গিয়ে “রাজউকের নকশা অনুযায়ী নির্মাণকাজ হচ্ছে না, ডেভিয়েশন হচ্ছে, সেটব্যাক নাই, পিলার জায়গামতো স্থাপন হয়নি, ভয়েড সমস্যা, পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়া হয়নি’- ইত্যাদি নানান অযুহাত আর ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখিয়ে প্রথমে ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নোটিশ দেন। পরে ভবন মালিকদের সঙ্গে সরাসরি কিংবা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঘুষ হাতিয়ে নেন মলয়। অপরদিকে চাহীদামতো ঘুষ না পেলে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ভবন ভাঙার হুমকি দেন। এভাবে ভবন মালিকদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন মলয়। ঘুষের টাকায় গাড়ি, রাজধানীতে ফ্ল্যাট এবং গ্রামের বাড়িতে কয়েক কোটি টাকার জমি কিনেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। মলয়ের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে- “একই ভবন থেকে নিজে নেন আবার সহকর্মী লেলিয়ে দিয়েও দফায় দফায় টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।”
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাতুয়াইল এলাকার মহিলা মাদ্রাসা সংলগ্ন এক ভবনের মালিক সময়নিউজকে বলেন, “নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নের আগে ৫ কাঠা জায়গার উপরে রাজউক আমাকে ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। বছর খানেক আগে আমি বাড়ি নির্মাণের কাজে হাত দেই। কিছুদিন বিরতি রেখে আবার কাজ শুরুর পর ৪/৫ মাস আগে হঠাৎ একজন লোক এসে নিজেকে রাজউকের কর্মকর্তা দাবি করে বলেন- আপনি রাজউকের নকশার ব্যত্যয় করে বাড়ি বানাচ্ছেন। যেকোন সময় আপনার ভবনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। পরদিন রাজউকে খবর নিয়ে জানতে পারি- টাকা দাবি করা লোকটি রাজউকের ইমারত পরিদর্শক মলয় চন্দ্র রায়। পরবর্তিতে মলয়কে নগদ তিন লাখ টাকা দিলে সে যাত্রায় রেহাই পাই।” এখানেই শেষ নয়। ভুক্তভোগী ওই ভবন মালিক আক্ষেপের সুরে আরও বলেন, “আমার এলাকার এমন কোন নির্মাণাধীন বাড়ি নাই যেখানে রাজউকের লোকজন হানা দেয় নাই। মনে হচ্ছে বাড়ি বানাতে গিয়ে পাপ করেছি। ঢাকা শহরে কয়টা বাড়ি রাজউকের নকশা মেনে হচ্ছে? কম-বেশি সবাই অনিয়ম করছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছুদিন পর পর রাজউকের লোকজন এসে ভয়-ভীতি, হুমকী-ধমকী দিয়ে আমাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে মলয়ের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি সময়নিউজকে বলেন, “আমি এক মাস আগে নতুন এলাকায় দায়িত্ব পেয়েছি। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে রাজি নই। কোন কিছু জানতে হলে আপনি অফিসে এসে আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিবেন।”
মলয় সম্পর্কে খবর নিতে গেলে নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রাজউকের এক কর্মচারী সময়নিউজকে বলেন, “মলয়ের খুঁটি অনেক গভীরে। তাছাড়া খুব সহজেই যে কাউকে ম্যানেজ করতে পারেন তিনি। কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই গত দুই বছর ভালো ভালো জোনের দায়িত্ব পেয়েছেন মলয়। যে কারনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে নালিশ কিংবা অভিযোগ আসলেও মলয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় না কেউ। মলয়ের মতো কতিপয় অসাধু কর্মচারীর ঘুষ-দুর্নীতি আর অপকর্মের কারনে পুরো রাজউকের সুনাম এবং ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।”
উল্লেখ্য, গত ১৬ এপ্রিল রাজউকের এক উচ্ছেদ অভিযানে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় নকশাবহির্ভূত নির্মাণাধীন ৩টি ভবনের কাজ বন্ধ করা হয়। এর মধ্যে ক্ষণিকালয় নামে ১০ তলা একটি ভবনে নগদ এক লাখ ও আইয়ুব নবী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ভবনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে ওই দুই ভবনের দেয়ালের নকশাবহির্ভুত অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পরিচালক মনির হোসেন হাওলাদারের নেতৃত্বে সেদিনের উচ্ছেদ অভিযানে অন্যদের সাথে ইমারত পরিদর্শক মলয় চন্দ্র রায়ও উপস্থিত ছিলেন।
সেদিনের উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে রাজউক জোন ৬/২ এর অথরাইজড অফিসার জান্নাতুল মাওয়ার বক্তব্য ছিলো- “উল্লেখিত ভবন মালিকরা রাজউকের অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় করে ১০ ও ৭ তলা ভবন নির্মাণ করেছে। অভিযানকালে ভবন মালিকরা তাদের নির্মাণ অনুযায়ী যথোপযুক্ত রাজউকের প্রমাণাদি দেখাতে পারেননি।”
ওই অভিযানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মনির হোসেন হাওলাদার বলেছিলেন, “বিগত দিনে রাজধানীতে যত ভবন নির্মাণ হয়েছে নীতিমালা ভঙ্গ করে সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা সরকার নিবে। রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলামের নির্দেশে বর্তমানে ভবন নির্মাণে কোন প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি চলবে না। আমরা সরেজমিন দেখেছি ভবন নির্মাণকারীরা নিয়ম বর্হিভূতভাবে সড়কে নির্মাণসামগ্রী দেখে মানুষের চলাচলকে বিঘ্নিত করছে। আর ভবন নির্মাণে রাজউকের কোনো প্রকার নীতিমালা তারা মানছে না। তাই আমাদের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
তবে, ১৬ এপ্রিলের অভিযান প্রসঙ্গে ক্ষণিকালয় ভবনের পরিচালক হাফিজ আহমেদ পাটোয়ারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি সময়নিউজকে বলেন, “টাকা ছাড়া রাজউকে কোন প্ল্যান পাস হয় না। এক একটি প্ল্যান পাস করতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। আর রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে তারা কোন কাজ করেননি।” তিনি আরও বলেছেন, “আওয়ামী লীগ শাসনামলে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ চলমান রেখেছি। অথচ ৫ আগস্টের পর নতুন করে আবারও নিয়ম বানিয়েছে রাজউক। বিগত দিনে এই অঞ্চলের কোন ভবন মালিক রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করেনি। কিন্তু কারও না কারও অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।”
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: