মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

Rupali Bank


দায় এড়ানোর কৌশলে, স্বপ্ন ভেসে যায় খালে


প্রকাশিত:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:২৫

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৪

ছবি সংগৃহিত

দেড় দশকে বাংলাদেশের অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় উন্নয়ন হয়েছে। বয়স যাদের পঁচিশের ঘরে, তাদের কাছে অবশ্য এসবই স্বাভাবিক। কারণ তারা আগের বাংলাদেশ দেখেনি। তাদের কাছে, সরকার প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা যারা আরেকটু পুরোনো, দেড় দশকের আগের দেড় দশকে বর্তমান বাংলাদেশ আমরা কল্পনাও করিনি, দাবিও করিনি।

যেমন, ঢাকায় মেট্রোরেল করতে হবে, এই দাবি করার মতো কল্পনাশক্তিও আমাদের ছিল না। দেড় দশকে এমন কল্পনা ছাড়ানো উন্নয়ন একটা নয়, অসংখ্য হয়েছে। উন্নয়ন এখন আমাদের কাছে ডালভাত।

বাংলাদেশ যখন সাবমেরিন কিনলো, আমরা বললাম সাবমেরিনের যুগে বাংলাদেশ। তারপর স্যাটেলাইট যুগ, মেট্রোরেল যুগ, এক্সপ্রেসওয়ে যুগ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুগ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যুগ—বাংলাদেশ নিয়মিতই নিত্যনতুন ধাপে পা রাখছে।

আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে হারিকেন আর কুপির আলোয়। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমাদের গ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ আসে। তাও একটা দুইটা বাল্বের টিমটিমে আলো। এখনকার মতো আলো ঝলমলে নয়। আমাদের ছেলেবেলায় রান্না হতো মাটির চুলায়, বড় জোর কেরোসিনের স্টোভে। এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, ঘরে ঘরে গ্যাস।

এখন আধঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকা, আমাদের ছেলেবেলার বিদ্যুৎহীন সময়ের চেয়েও অসহনীয়। আমাদের মামা বাড়ি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ইলিয়টগঞ্জ থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে, সালিয়াকান্দি রঘুনাথপুরে। আমার জন্ম সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সেইখানে ছিলাম। দুর্গম সেই এলাকায় যাওয়ার দুইটাই উপায়-বর্ষায় নৌকা, গ্রীষ্মে হাঁটা। এখন গাড়ি নিয়ে মামাবাড়ির উঠানে নামা যায়।

পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীর ওপর সেতু বানিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংককে টেক্কা দিয়েছে নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু দিয়ে পরীক্ষামুলকভাবে রেল চলছে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে আরেক যুগ বদলানো উন্নয়ন-কর্ণফুলী টানেল। আমরা দাবি করতাম, কর্ণফুলী সেতু মেরামতের। আর আমরা পাচ্ছি, নদীর নিচে টানেল। শুরুতে যেমনটি বলছিলাম, দেড় দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় গতিতে।

এই অবিশ্বাস্য গতির উন্নয়ন নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, প্রশ্ন নেই। কিন্তু কর্ণফুলী টানেলের খবরের পাশে যখন 'নালা বা খালে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বা কলেজ ছাত্রী বা শিশু নিখোঁজ বা নিহত' এই ধরনের শিরোনাম দেখি, তখন সব উন্নয়ন অর্থহীন মনে হয়।

মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। দেড় বছরে নালা বা খালে পড়ে মারা গেছেন অন্তত ১০ জন। এবং এই ঘটনাগুলো ঘটেছে কর্ণফুলী টানেলের খুব কাছে। মানুষের জীবনের যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেইখানে হাজার কোটি টাকার টানেল দিয়ে কী হবে, এমন ছেলেমানুষি তুলনা আমি করবো না।


প্রত্যেকটার কাজ আলাদা, প্রকল্প আলাদা, প্রয়োজনীয়তা আলাদা, গুরুত্ব আলাদা। কিন্তু তারপরও মানুষের জীবন আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। শুধু আমার কাছে, প্রতিটি মানুষের জীবনই অমূল্য। তাই মানুষকে বাঁচানোই হওয়া উচিত প্রথম প্রায়োরিটি।

আমার জন্ম কুমিল্লায়। কিন্তু বাবার চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় কিছুদিন কেটেছে চট্টগ্রামে। মুরাদপুর মোড়ে অন্ধ ও মূক বধির বিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। চট্টগ্রাম তাই আমার হৃদয়ের গহীনে ভালোবাসার একটা জায়গা দখল করে আছে।

ছেলেবেলার শহর বলেই নয়, চট্টগ্রাম অসাধারণ সুন্দর একটা শহর। একই সঙ্গে সাগর, নদী, পাহাড়ের এমন সম্মিলন সত্যিই বিরল। শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী, অর্থনীতির লাইফলাইন। সেই লাইফলাইনে আমার চোখেই ৫০ বছর ধরে একটি সমস্যা দেখে আসছি—জলাবদ্ধতা।

সামান্য বৃষ্টিতেই চট্টগ্রাম শহর ডুবে যায়। সেই ৭৪ সালে যেমন দেখেছি, এখনো তেমন। বরং নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি আরও বেড়েছে বলেই ধারণা। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক লেখালেখি হয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকা জলে গেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি।

জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত, সমাধানও আকাশকুসুম নয়। তবুও সমাধান হচ্ছে না, দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে। এখন নাকি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। খুবই ভালো খবর। কিন্তু ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সমস্যার সমাধান হবে না। কিছু টাকা নেতাদের পকেটে যাবে, কিছু ইঞ্জিনিয়ারদের পকেটে, আর কিছু যাবে জলে।

ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, আমার একটাই ভাবনা মানুষের জীবন। জলাবদ্ধতা হলেই দুর্ভোগের সাথে সাথে একটা খবর নিয়মিত হয়ে গেছে। খোলা খাল বা নালায় পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। দেড় বছরে মারা গেছে ১০ জন। আরও পেছনে গেলে সংখ্যাটা বাড়বে নিঃসন্দেহে। মৃত্যুর দায় নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পরস্পরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। দায় চাপানোর এই পুরোনো খেলার আড়ালে মারা যাচ্ছে মানুষ।

চট্টগ্রামে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার খাল-নালা রয়েছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খাল আছে ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দাবি, দুই বছরে ২৫ হাজার বর্গফুট স্ল্যাব মেরামত ও নির্মাণ করা হয়েছে, ১৫ হাজার বর্গফুট নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। তার মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খোলা খাল-নালাও রয়ে গেছে।

জলাবদ্ধতার সময় চট্টগ্রামের রাস্তা আর নালা বা খাল একাকার হয়ে যায়। কোনটা রাস্তা, কোনটা খাল বোঝার উপায় থাকে না। ফলে টুপটাপ মানুষ খালে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সবার লাশও খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা মানুষ মানে একটা পরিবার, একটা স্বপ্ন।

খাল-নালা নিরাপদ রাখা সিটি করপোরেশনেরই কাজ। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার কোটি টাকা টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে কিছু এলাকার দায় পড়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে। এই সুযোগে সিটি করপোরেশন পুরো দায়টাই উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে।

দায় কার সেটা নিয়েও আমার মাথাব্যথা নেই। প্রয়োজনে হাইকোর্ট দুইপক্ষকে ডেকে দায়-দায়িত্ব, কাজের পরিধি ঠিক করে দিক। আমাদের চাওয়া একটাই, সহজ-সরল চাওয়া আর একজন মানুষও যেন নালায় বা খালে ডুবে না যায়। প্রকল্প কতটুকু হয়েছে জানি না, জানতে চাইও না। খালি চাই, এক ইঞ্চি খাল বা নালাও যেন অরক্ষিত না থাকে। নালাগুলো ঢেকে দেওয়া হোক স্ল্যাবে, ঢাকনা থাকুক প্রতিটি ম্যানহোলে, খালগুলো নিরাপদ থাকুক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে। দায়িত্বশীলদের ঠেলাঠেলি আর খামখেয়ালির খালে যেন আর কারও স্বপ্ন ভেসে না যায়। মানুষ না বাঁচলে সবকিছুই অর্থহীন।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top