মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

Rupali Bank


কাজী শাহেদ আহমেদ : সাহসী প্রকাশকের প্রস্থান


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৭:২২

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৫

ছবি সংগৃহিত

কাজী শাহেদ আহমেদ, বাংলাদেশের শিল্প, বাণিজ্য এবং গণমাধ্যমের এক সফল পুরুষ, পরিণত বয়সেই তিনি হয়েছেন প্রয়াত। কিছু মানুষের অভাব কখনো পূরণ হয় না, তাদের মৃত্যু এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করে, তারা থেকে যান মানুষের অন্তরে, তাদের সৃষ্টিতে। কাজী শাহেদ আহমেদ সেই রকম একজন মানুষ।

আমার তাকে চেনা-জানার সুযোগ হয় ১৯৯১ সালে, ‘আজকের কাগজ’ এবং ‘সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’ পত্রিকায় কাজ করার মধ্য দিয়ে। চাকরি দিয়েছিলেন সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান। কাজী শাহেদ সেই দুই পত্রিকার মালিক, সেই সুবাদেই মাঝে মাঝে তাকে অফিসে দেখতাম, সামান্য কথাবার্তা, কুশল বিনিময় এইটুকুই। কিন্তু কাজী শাহেদ আহমেদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ ছিল, তার কথা বলার ধরন, হাঁটার স্টাইল, পোশাক পরিচ্ছদ সেই বয়সেই আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় লাগতো।

আমার বয়স তখন নিতান্তই কম, ২১-২২ বছরের তরুণ আমি। মাঝে মধ্যে আমার মতো তরুণ এবং নবীন কর্মীদেরও ডেকে কথা বলতেন, কুশল জানতে চাইতেন, আমি অবাক হতাম। কারণ তিনি এসে সম্পাদক বা সিনিয়র দুই একজনের সাথে কথা বলেই চলে যেতে পারতেন, সেই জায়গায় আমার মতো একজন নবীন, যার কি না গণমাধ্যমে কোনো পায়ের চিহ্নও পড়েনি তখনো, তার সাথে যিনি নিজ থেকে কথা বলেন, তিনি নিশ্চয়ই আর দশ জন সাধারণ মালিকের মতো নন। শাহেদ ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তখন থেকেই শুরু।

কাজী শাহেদ আহমেদ প্রকৌশলী এবং সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। আশির দশকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ব্যবসা শুরু করেন, দশকের শেষ দিকে তিনি যুক্ত হন গণমাধ্যম প্রকাশনার সঙ্গে, প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলে যে দুই তিনটি পত্রিকা এরশাদ বিরোধী জোরালো অবস্থান নিয়েছিল তার মধ্যে খবরের কাগজ অন্যতম।

তরুণ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান ছিলেন সম্পাদক, তখন তুমুল জনপ্রিয় ওই পত্রিকায় দেশের অধিকাংশ নামী এবং বিশিষ্ট লেখকরা নিয়মিত লিখতেন, পাশাপাশি সেইখানে কাজ করতেন আমার মতো অনেক তরুণ।

সেই পত্রিকার সাফল্যের হাত ধরেই এরশাদ পতনের পরে প্রথম বাংলা দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আজকের কাগজ। সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের উদ্যোগে কাজী শাহেদ আহমেদ সম্মত হয়েছিলেন বলেই সেইদিন আজকের কাগজ প্রকাশিত হতে পেরেছিল।

আজকের কাগজ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে মাইলফলক, তরুণ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান যে সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ, এক ঝাঁক তরুণ সংবাদকর্মী নিয়ে তারা তখন যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তা সার্থক হয় অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই।

তুমুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবেও সফল হয় আজকের কাগজ, তারচেয়ে বড় কথা, ওই পত্রিকার মাধ্যমে কাজ শুরু করে অনেক সাংবাদিক পরবর্তীকালে দেশের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকের মর্যাদা ও সুনাম অর্জন করেছেন। অনেকে পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন, টেলিভিশনের বার্তা প্রধান হয়েছেন, দেশ সেরা হয়েছেন। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ পত্রিকার সম্পাদকের স্বাধীনতা এবং মালিকের হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকা।

এখনকার গণমাধ্যমে এমন মালিক খুঁজে পাওয়া বিরল যিনি নিজের রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক বা পারিবারিক স্বার্থে তার পত্রিকা বা সংবাদ মাধ্যম ব্যবহার করেন না, কিন্তু কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাকে তার ব্যবসা বা কোনোকিছুর জন্য আজকের কাগজকে ব্যবহার করতে দেখিনি। সত্যিকার অর্থেই পত্রিকা থেকে নক্ষত্রের দূরত্বে থাকতেন তিনি।

পত্রিকার সাংবাদিকদের সবসময় তিনি সাহসী সংবাদ প্রকাশে উৎসাহ দিতেন এবং যেকোনো নতুন ও উদ্ভাবনী আইডিয়া পছন্দ করতেন। মনে করা যেতে পারে, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুন প্রথম দৈনিক হিসেবে আজকের কাগজেই প্রকাশিত হয়।

১৯৮৮-৮৯ সালে বিটিভিতে হুমায়ুন আহমদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’ প্রচারিত হয়, ওই নাটকে টিয়া পাখির কণ্ঠে ‘তুই রাজাকার’ স্লোগান উচ্চারিত হওয়ার পর সারা দেশে তা নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন হয়। তখন বিএনপি ক্ষমতায়, দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস, নিজেও একাত্তরে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী।

১৯৯১ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আজকের কাগজ শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুন দিয়ে একটি সিরিজ প্রকাশ করে, যার নাম ছিল ‘তুই রাজাকার’। প্রতিদিন একজন করে রাজাকারের কার্টুন আর তার সাথে রাজাকারের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে একটা প্রতিবেদন থাকতো।

১ তারিখ গোলাম আযমকে দিয়ে এই সিরিজের শুরু, মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুল কাদের মোল্লা, আব্বাস আলী খান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুর রহিম, আবদুস সবুর খান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ কুখ্যাত সব রাজাকারের কার্টুন তখন প্রকাশ করেছে আজকের কাগজ।

১৬ ডিসেম্বর এই সিরিজের শেষ পর্ব ছিল তখনকার রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে নিয়ে, যেহেতু তখন তিনি রাষ্ট্রপতি, তাই তার কার্টুন আঁকা এবং সংবাদ প্রকাশ আইনত সম্ভব না হওয়ায় শেষদিন কার্টুনের জায়গায় একটা খালি বক্স করে রাখা হয় আর শিরোনাম দেওয়া হয়ে ‘বিশ্বাসেই অবিশ্বাস’।

এই রকম সাহসিকতা তখন দেখিয়েছে আজকের কাগজ এবং মালিক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে আপত্তি তো দূরের কথা, এইসব বিষয়ে চরমভাবে উৎসাহ দিতেন কাজী শাহেদ আহমেদ। আজকের দিনে এমন সাহসী মালিকের কথা ভাবাই যায় না। উপরন্তু রিপোর্টারদের অনেক নিউজ নিয়ে তখন বিএনপি সরকার বা অনেকে মামলা করতো, প্রতিটি মামলায় আসামি থাকতেন তিনি, একবার তিনি কোনো এক মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। পত্রিকার প্রতি এমনই ভালোবাসা ও একাত্মতা ছিল তার।

তখন থেকেই দেখেছি, খুব সাদাসিধে জীবনযাপনের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসা ছিল। ব্যবসা নিয়েও তিনি ছিলেন উদ্ভাবনী চিন্তক। সেই সময় তিনি জেমিনি সি ফুড নামে এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে মাছ রপ্তানি করতেন, পাশাপাশি জেমকন কনস্ট্রাকশন নামের এক কোম্পানি বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করতো। এক পর্যায়ে তিনি দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চা উৎপাদনের কাজ শুরু করেন।

সারা জীবন যেখানে সিলেট অঞ্চল ছিল বাংলাদেশের চা উৎপাদনের একমাত্র জায়গা সেই জায়গায় তিনি পঞ্চগড়ে বিশাল অর্গানিক চা বাগান করে খুলে দিলেন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। এখন আরও অনেকে ওই এলাকায় চা বাগান করেছেন। আর তার কাজী টি আজ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড। বিদেশেও রপ্তানি হয় সেই চা, এমনকি লন্ডনের বিশ্বখ্যাত হ্যারডস নামের দোকানেও আমি কাজী টি বিক্রি হতে দেখেছি।

তার আরেক ব্যবসায়িক সাফল্যের উদাহরণ মীনা বাজার। সুপার শপের ধারণা যখন বাংলাদেশে খুব একটা পরিচিত নয়, সেই সময় তিনি মীনা বাজার শুরু করেন এবং সফল হন, বাংলাদেশে এখন দৈনন্দিন হাট বাজারের জন্য মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার এক নাম মীনা বাজার। বলে রাখা দরকার, তার স্ত্রী, রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী আমিনা আহমেদের নামেই তিনি মীনা বাজারের নামকরণ করেছেন।

কাজী শাহেদের আরেক অসাধারণ সৃষ্টি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বা ইউল্যাব, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অসংখ্য শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কাজ করছে ইউল্যাব, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো এবং বিশ্বের অনেক আলোচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত ইউল্যাবে ক্লাস নিতে আসেন। স্থানীয় পর্যায়েও সুযোগ্য শিক্ষক কর্মকর্তারা পরিচালনা করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন আবাহনী ক্লাব পরিচালনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

আমি খুব কম সময় তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, তবে সবসময়ই তার সাথে কমবেশি যোগাযোগ ছিল, তার খোঁজখবর রাখতাম। তিনি একবার রাজনীতি করার, সংসদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, যশোর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি, শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং পরাজিত হন।

পরবর্তীকালে তার পুত্র নাবিল আহমেদ যশোর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন হয়তো পুত্রের ভেতর দিয়ে বাস্তবায়ন করে গেছেন কাজী শাহেদ।

কাজী শাহেদ আহমেদ চলে গেছেন পরলোকে, কিন্তু তার কাজ, তার আদর্শ, তার সাহসিকতা দৃষ্টান্ত রেখে গেছে; যা যুগ যুগ অনুপ্রেরণা দেবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

জ. ই. মামুন ।। প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন বাংলা


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top