মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১

Rupali Bank


শক্তি প্রদর্শন কি জরুরি


প্রকাশিত:
২৭ আগস্ট ২০২৩ ১৮:৪৬

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৫০

ছবি সংগৃহিত

নিজেকে গঠন ও সংরক্ষণ করার জন্য মানুষের তিনটি গুণের প্রয়োজন মনের শক্তি, স্বচ্ছ ধারণা ও স্থির প্রতিজ্ঞা। নিজেকে গঠন করা খুব একটা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়, কিছু অনুশাসন মেনে চললে তা করা যায়। প্রায়ই দেখা যায়, যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনায় অথবা অসীম সাহসিকতার সাথে কিছু লোক কাজ শুরু করে; কিন্তু কিছু সময় পরে সেই নতুনত্ব এবং উৎসাহ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যায়।

আবেগ অর্থাৎ ভাবাবেগের বশেই মানুষ একটা অভ্যাসে প্রবৃত্ত হওয়ার সংকল্প করে, কিন্তু এই নতুন বিষয়টি যদি খুব তাড়াতাড়ি তাদের আশানুরূপ না হয়, অথবা একটু দেরিতে ফল দেয়, তাহলে ওতে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে সরাসরি তা ছেড়ে দেয়। তখন তারা এই অভ্যাসকে অকেজো, ফল প্রদানে অক্ষম অথবা এর মধ্যে কিছু ভুল আছে বলে দাবি করে। তাই বলা যায়, যেকোনো বিষয়ের বেলায় অপর্যাপ্ত অধ্যবসায় এবং ধৈর্যশক্তির অভাবজনিত কারণগুলোই ব্যর্থতার মূলসূত্র।

এই সহজ সত্য মানুষের কাজের শুরুতেই বুঝতে হবে। এটা অবশ্যই জানা উচিত যে, আমরা কাজ এবং প্রচেষ্টার ওপর জোর খাটাতে পারি না অথবা আমাদের সংকল্পকে অবজ্ঞাও করতে পারি না। পরিস্থিতির সাথে নিজের বোধকে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারলেই কেবল শক্তির যথার্থ জাগরণ হয়। কাজটা করা শক্ত, তবে খুব জরুরি।

যখন উপযুক্ত সময় আসবে, তখনই আমাদের যেকোনো মূল্যে, কাজ এবং তার ফলের ঊর্ধ্বগামী স্রোত বা প্রবাহের যে সুযোগ, তার সঠিক ব্যবহার করা উচিত। অভ্যাসকে সময়ের আগেই হতোদ্যম হয়ে পরিত্যাগ করা উচিত নয়। এটা বরং সুবিবেচনার সাথে যথাযথভাবে প্রথমেই পরীক্ষা করা উচিত যে, জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে এর সমন্বয় বিধানের নির্দেশ বা ইঙ্গিত আছে কি না।

যে অভ্যাস কারও কোনো ক্ষতি না করে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাই আসলে ভালো অভ্যাস। শুধু অন্য শিক্ষার প্রতি নয়, নিজের শিক্ষার প্রতিও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, চলার পথে কোনটা সঙ্গী করতে হবে আর কোনটা ওখানেই ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে।

মানুষের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জড়তা বা আলস্য। সুতরাং শক্তি কী এবং এটা কীভাবে বিকশিত হয়, তা বিশেষভাবে জানা উচিত। কোন উপায়ে শক্তির বিকাশ লাভ ঘটে, আমাদের এটাও জানা উচিত, যাতে এর জন্য আমরা একটি মাপকাঠি বা নির্দেশনা প্রকাশ করিতে পারি। দুই উপায়ে মানুষের মনের মধ্যে শক্তির সঞ্চার ঘটে—সাধারণ শক্তি বা মানুষের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি এবং ধ্যানবলে বা ভাবনার চর্চায় যে মানসিক উৎকর্ষ সমৃদ্ধ শক্তির জাগরণ হয় অথবা মানুষের ভেতরে স্থিত থাকে।

সাধারণ শক্তি দৈনন্দিন জীবনে সহজেই দেখা যায়। এই শক্তি যদি আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে থাকে, তাহলে ধ্যানের চিত্তোন্নতি লাভের জন্য আরও শক্তি সঞ্চয় করতে মন সক্ষম হবে। শক্তিমান মানুষের পক্ষে সাধনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। আর দ্বিতীয়টি দেহের ধর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার ফলে উৎপন্ন করা যায়, যদি আমরা প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহযোগে আলস্য ও জড়তাকে উৎপন্ন হওয়ার সুযোগ না দেই। এর উৎপত্তি ও বিকাশ দুটোই হয় মনে এবং মনের কড়া অনুশাসনেই মানুষ একে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে।

এই দুই প্রকার শক্তির মধ্যে, সাধারণ শক্তিতে আলস্য যুক্ত হতে পারে এবং প্রায়ই হয়, যদি দ্বিতীয় অবস্থার উপস্থিতি না থাকে। সাধারণ শক্তি নিজে নিজে আলস্যকে দূর করতে পারে না, বরং ব্যাপকভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। পক্ষান্তরে, অতিরিক্ত দৈহিক শক্তি চঞ্চলতার জন্ম দেয়। ভালো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে সাধারণ শক্তির প্রকাশ মানুষের মধ্যে দেখা যায়।

মনের জোরেও সাধারণ শক্তির প্রকাশ অনেকটা বেড়ে যায়। কেবল শক্তির প্রকাশ‌ই যথেষ্ট নয়, যদি সেটা ভ্রান্ত পথে হয়ে থাকে। এভাবে আরও একটি শ্রেণিবিন্যাস করা যায় শারীরিক বা দৈহিক শক্তি, যা কায়িক শ্রমে সাহায্য করে এবং মানসিক শক্তি, যা চিত্ত বিকাশের জন্য কাজে লাগে।

শারীরিক শক্তি বলতে বোঝায় কম খেয়ে এবং কম ঘুমিয়ে বেশি কাজ করতে পারার সামর্থ্য। একাগ্র হয়ে কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে যে সাধনার দরকার, তার জন্য এই সামর্থ্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। মানসিক শক্তি বলতে বোঝায় মনের তীক্ষ্ণ প্রকাশ, গভীর অনুধ্যান ও অনুশীলনের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা বা অনুরাগ।

শক্তি বা প্রচেষ্টা বলতে মূলত ক্রমাগত চর্চাকেই বোঝায়। এখন কথা হচ্ছে, ক্রমাগত চর্চা কী? সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি, সম্পদ এবং যশ-খ্যাতি অর্জনের প্রচেষ্টায় অন্ধভাবে আত্মনিয়োগ করলে বিভিন্ন বিপদ ও বিপর্যয় এসে উপস্থিত হয় এবং এর ফলে দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ-নিরোধ এবং দুঃখ-নিরোধের উপায় খুঁজে বের করার জন্য কোনোরূপ প্ৰচেষ্টা মনের মধ্যে জন্মে না। মন তখন অন্ধের মতো সমৃদ্ধির পেছনেই ছোটে এবং এর গন্তব্য কোথায় কিংবা আদৌ কোনো গন্তব্য আছে কি না, এসব নিয়ে ভাবে না।

শক্তিচর্চার চারটি প্রকারভেদ আছে

১। সৃষ্ট বা ঘটমান পাপ বা খারাপ কাজকে পরিত্যাগ বা অতিক্রম করার প্রচেষ্টা; ২। যে পাপ এখনো করা হয়নি বা খারাপ কাজের উৎপত্তিকে বাধা প্রদানের প্রচেষ্টা; ৩। যে ভালো কাজটি এখনো করা হয়নি, তা করার জন্য যে প্রচেষ্টা, তা উদ্দীপিত করা; ৪। যে ভালো কাজটি করা হয়েছে, তার সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা।

কাজ বলতে এখানে শারীরিক, বাচনিক এবং মানসিক সব কাজকেই বোঝায়। এতে আরও বোঝায় সেই প্রক্রিয়াকে, যেটা কেউ নিজের জীবনকে একটা নির্দিষ্ট ধারণা ও ব্যবস্থার ওপর নিয়োগ করে এবং হিংসা বা দ্বেষ, সদিচ্ছার অভাব প্রভৃতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করার মানসিক গঠনটি বুঝতে সক্ষম হয়। বিফলতা ও হতাশা এই ধরনের কাজের‌ই অন্তর্ভুক্ত।

যদি কেউ এই চারটি উপায়ে নিজের কাজে প্রবৃত্ত হয়, তাহলে তার মধ্যে শক্তি উৎপন্ন হবে। তবে এটা ঠিক, আমাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিফলতা এবং নেতিবাচক নানান অবস্থা থাকতে পারে। এমনটা ঘটলে মানুষ তার কাজ এবং কাজের ফল সম্পর্কে ধারণা করতে পারে এবং উপলব্ধি করতে পারে যে, এই অপ্রীতিকর অবস্থা তার নিজের মনের মধ্যেই বিদ্যমান, এর জন্য অন্যকে দোষারোপ করা যায় না। এই সবকিছুই তার নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কাজের ফল। অতীতের কাজ‌ই এখন তাকে কষ্ট দিচ্ছে।

এতে আমাদের কোনোক্রমেই হতাশ হওয়া উচিত নয়। বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই কাজ করে যেতে হবে। হতাশা ও ব্যর্থতা, কর্ম এবং কর্মফলের বিষয়ে বিপরীতমুখী স্রোত সৃষ্টি করবে। এমন স্রোত মানুষ তার ভাবনার মধ্যে উপলব্ধি করে। এর কারণেই সৃষ্টি হয় আলস্য ও জড়তা। বিভিন্ন উপায়ে একে দূর করে বাধা অতিক্রম করা যায়। কীরকম? দেখা যাক।

মৃত্যু ভাবনা মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে হবে, অর্থাৎ এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, মৃত্যু যেকোনো সময়েই উপস্থিত হতে পারে। যদি আমরা জীবনকে উন্নত অবস্থায় নিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। মৃত্যুর আগেই যদি সম্মানের সাথে বাঁচা না যায়, তাহলে এই পৃথিবীতে আসার আর কী অর্থ থাকল?

অন্য কেউ যখন আনন্দ উপভোগ করে, তখন সংযত হয়ে নিজেও সেই আনন্দের অংশীদার হতে হবে। এই অংশীদারিত্বের কাজটি এমনভাবে করতে হবে যাতে আমরা ঈর্ষান্বিত হওয়ার বদলে সুনির্দিষ্ট পথে চলার প্রেরণা লাভ করতে পারি। আমাদের বর্তমান জীবনে যেন কোনো অভিযোগের কারণ সৃষ্টি হতে না পারে, তার জন্য আমরা ভালো কাজ করব।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সব থাকা সত্ত্বেও মানুষ যদি ভালো চিন্তাভাবনা ও কাজের মাধ্যমে নিজের আত্মার যত্ন নিতে না পারে, তাহলে সে ক্রমেই দৈহিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সহজ ব্যাপারগুলো মাথায় রাখলে আমরা মনের শক্তিকে উদ্দীপিত করতে পারব। কিন্তু শক্তির এই যে প্রকাশ, তা কীভাবে দেখা যায়?

আধুনিক যুগে আমাদের দৈনন্দিন জীবন পার্থিব বা বৈষয়িক সম্পদ, ধন, শ্রদ্ধা, যশ ইত্যাদি লাভের কাজকর্মে প্রবলভাবে কেন্দ্রীভূত; কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ সুখী নয়। এটা বুঝেও মানুষ ঘুরে ফিরে বাহ্যিক সুখেই আবদ্ধ হয়। মানসিক শৃঙ্খলার অভাবের ফলে নৈরাশ্য এবং অতৃপ্তি থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন প্রকারের বিশৃঙ্খল চেতনা ও অবচেতনায় জীবন পরিপূর্ণ হয়ে দুঃখের উৎপত্তি হয়।

বেশিরভাগ লোকই খুব একটা জীবনের সাথে সমতা রক্ষা করে না এবং এর ফলে মুহূর্তের তাড়নায় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যায়। এটা একধরনের অনর্থবোধক ব্যর্থতা। দৈনন্দিন জীবনে বাস্তব অভ্যাসের গতানুগতিক শিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের অবমূল্যায়নের সূচনা ঘটে। এখান থেকেই পরবর্তীতে দুঃখের উৎপত্তি ঘটে। তাহলে কীভাবে একে পরিত্যাগ করা যায়?

অবস্থার উন্নতির জন্য প্রথম পদক্ষেপ হলো দৈনন্দিন জীবনে নিয়ন্ত্রিত আচরণের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হওয়া। এভাবে অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা জীবনের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা সম্ভব এবং এতে ধর্মের মৌলিক নিয়মাবলী বোধগম্য হয়। জ্ঞানের সম্যক চর্চার, নৈতিক আচরণের এবং যথাস্থানে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, সহযোগিতা ইত্যাদি দানের অভ্যাসের মাধ্যমে শক্তি অর্জনের বা উৎপাদনের জন্য প্রথম পদক্ষেপটি নেওয়া যায়। কারও চিন্তাধারাকে মৌলিক নীতিশিক্ষা এবং মৌলিক ভাবনাশিক্ষার উপায় সম্বলিত বিস্তৃত শিক্ষার প্রতি পরিচালিত করলে চিত্ত শান্ত করা সম্ভব। চিত্তের বিক্ষিপ্ত অবস্থার জন্য দায়ী হচ্ছে—অসংগত পথে চিত্তকে ব্যস্ত রাখার দুর্বার মোহ।

পরবর্তী স্তর হলো, জরুরি যা কিছু, তাকে সহজে মেনে নেওয়ার ও গ্রহণ করার মতো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনাকৌশল আয়ত্ত করা। ভাবনার পথে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের বাধাবিপত্তি পরিত্যাগ করে তা থেকে পালিয়ে না গিয়ে বরং তার সম্মুখীন হতে শিখেছি, যাতে আমাদের চিত্ত আরও সবল এবং ভারসাম্যতা অর্জনে সক্ষম হয়।

শুধু পার্থিব স্তরে থেকেই যারা পরিপক্বতা লাভ করেছে, তারা যে কেবল জীবনের বাধাবিপত্তি থেকে পালিয়ে বেড়ায়, তা-ই নয়, বরং চিত্তের উৎকর্ষের পথে তেমন এগোতে পারে না। এখান থেকে বেরোতে না পারলে বিত্ত বাড়ানো হয়তো যাবে, তবে চিত্তের স্বস্তি কিছুতেই আসবে না। দিনশেষে, বিত্তের চেয়ে চিত্ত বড় ঐশ্বর্য। ভালোভাবে বাঁচার ক্ষেত্রে বিত্তের চেয়ে চিত্তের ভূমিকা অনেক বেশি।

সর্বোপরি, দৈনন্দিন জীবনে জীবনসংগ্রামের দৃঢ়তার মধ্যে এবং দায়িত্বজ্ঞানের উপলব্ধিতে শক্তি নিজেই বিকাশ লাভ করে। এটা প্রত্যেকের‌ই উপলব্ধি করা উচিত যে, প্রত্যেকেই নিজের কাজের উত্তরাধিকারী। তাই নিজের অবস্থার উন্নতি বিধানের জন্য প্রত্যেকের‌ই চেষ্টা-সহকারে সংগ্রাম করা উচিত।

ভালো কাজ করার প্রেরণা এবং খারাপ কিছুকে রুদ্ধ করার প্রেরণা যখন বেড়ে যায় এবং সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে, তখন মানুষের মধ্যে সম্যক চর্চার প্রতি তীব্র বেগে ধাবিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় হয়। নিজের চিত্তকে সুস্থির বা শান্ত করার ফলে তখন জীবনের গতি ফিরে আসবে এবং একসময় সেই চিত্ত বাহ্যিক বিষয়বস্তু ছেড়ে কেবলই আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত হয়। পার্থিব পথে চলার সময় আধ্যাত্মিক অনুপ্রাণনকে কাজে লাগাতে পারলে চলার পথটি অনেক সুন্দর ও অনুকরণীয় হয়।

এই ব্যাপারে একজন ভালো বন্ধু চমৎকারভাবে সাহায্য করতে পারে। এখানে 'বন্ধু' অর্থ মানসিক উৎকর্ষসাধনে সহায়তা দানকারী অথবা নিজের কাজে মনসংযোগ করার সার্বক্ষণিক উৎসাহ দানকারী। এমন বন্ধু পার্থিব বস্তু, যা মায়া উৎপন্ন করে এবং তা থেকে দুঃখ আসে, তার প্রতি নিস্পৃহ থাকতে শেখায় এবং দোষ-গুণ বিচারপূর্বক পথে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা দেয়।

এভাবে একজন হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু আমাদের শিক্ষক হিসেবে কাজ করে এবং যদি সে নিজে তা করতে অক্ষম হয়, তবে যার সেই বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান আছে, তাকে বন্ধুর জন্য কাজে লাগায় কিংবা নিজেই তার কাছ থেকে শিখে বন্ধুর কাজে লেগে যায়। একজন বন্ধু ভালো কিছুতেই তার বন্ধুর জীবনকে কেন্দ্রীভূত ও প্রতিষ্ঠিত করে।

যে ব্যক্তি তার প্রাত্যহিক জীবনে শক্তিধর হয়ে বাঁচেন, তিনি জীবনের বিভিন্ন জরুরি মনোভাবকে সমুন্নত রাখতে পারেন। এই মানসিকতা সমাজ ও ব্যক্তির জন্য ভালো গুণগুলো বিকাশের আন্তরিক ইচ্ছেকে তুলে ধরে। এর দ্বারা এটা বোঝায় না যে, ওই ব্যক্তি পার্থিব সাফল্যের বিষয়ে উদাসীন। কোনো শক্তিকে উন্নততর উদ্দেশ্যে কাজে লাগালে তা ভিন্ন ধরনের হবে। ওতে কোনো শ্রেষ্ঠত্বভাবের গরিমা, জ্ঞানের অভিমান বা অনুরূপ কিছু উৎপন্ন হতে পারে না।

পার্থিব সাফল্য জরুরি, তবে তা পেয়ে যাওয়ার পর চিত্তের শুদ্ধতা, শান্তি ও বিকাশের জন্য সফল ব্যক্তি কোন জায়গায় আশ্রয় নেবেন, তা আগেই নির্ধারণ করে নেওয়া অধিক জরুরি। সময়মতো এই কাজটি করতে না পারলে সব পার্থিব সাফল্য অনর্থক মনে হয় এবং এই ভাবটি ব্যক্তিকে মানসিকভাবে পুরোপুরি ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত করে দেয়।

সাফল্য অর্জনের জন্য আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ চর্চা হচ্ছে ভাবতে শেখা। ভাবনার অভ্যাসের মাধ্যমে উপযুক্ত শক্তি বা ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, ভাবনার অভ্যাসের মাধ্যমে শক্তির উৎপাদন বলতে আমরা কী বুঝি?

চার প্রকারের চর্চার উপলব্ধির জন্য চেষ্টাই প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য। একই সময়ে এটাও জরুরি জীবনে চলার পথে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা এবং ভয়ংকর অবস্থাতে হতোদ্যম বা ভীত না হওয়া। গভীর অধ্যবসায় ও দৃঢ়তার সাথে মাস বা বৎসরকাল অভ্যাস করার পর সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে শক্তি মানুষকে তার নিজের ভাবনার পথ‌ই অবিরত অনুসরণ করার প্রেরণা দান করে। এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে, তার সবই আমাদের কর্মফল। জীবনের উত্থান-পতনে আমাদের হতবুদ্ধি এবং প্রলোভিত হওয়া উচিত নয়। শক্তি অর্থাৎ দৃঢ়তা এবং অধ্যবসায়ের সাথে সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। অদৃষ্টের কিছু হাত এখানে আছে যদিও, তবু মানুষ নিজের অসীম সাধনার মাধ্যমে সেই হাতকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

মানসিক উৎকর্ষ লাভের অভ্যাসের মধ্যে যতটুকু সম্ভব দৃঢ়তার সাথে প্রতিদিন‌ই সাধনার চর্চা বা অভ্যাস করা খুবই প্রয়োজন। যদি কেউ খুব তাড়াতাড়িই এটা ধরে নেয় যে, ‘আমি আজ কোনোমতেই সফল হব না।’ অথবা যদি সে অন্যান্য সহজ এবং কম জরুরি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত সবসময় যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বেশি জরুরি কাজটি বারবার স্থগিত করে, তাহলে তার প্রেরণার ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটে। অন্যদিকে, শক্তির শিথিলতা, আলস্য এবং জড়তা বেড়ে যায় এবং তার সব প্রচেষ্টাকে মূল্যহীন করে দেয়।

কেউ যদি প্রথম প্রচেষ্টার পরই হঠাৎ শক্তির উন্মেষের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে, তবে সাবধান! আমরা সবসময় আমাদের ইচ্ছের সাথে জীবনের অবস্থাকে বোঝাপড়ায় আনতে পারি না। আমাদের সব অবস্থাই আমাদের পূর্বের কর্মফলের সমষ্টি। এই মুহূর্তে আমরা বড়জোর এই চেষ্টা করতে পারি, যাতে ভবিষ্যতে অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয় আগের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে। অহেতুক ও অবিবেচনাপ্রসূত প্রত্যাশা সবসময়ই মানুষের জীবনে হতাশা নিয়ে আসে।

আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখি, জীবনে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমেই আমাদের মানসিক পরিপক্বতা লাভ হয়। তাই আমাদের উচিত, জীবনের এই প্রতিকূল অবস্থাকে প্রথমে না বুঝেই পাশ কাটিয়ে বা এড়িয়ে না যাওয়া। যদি আমরা সেই প্রতিকূল অবস্থার বাস্তবতাকে জানতে পারি, তখন তাকে আমরা সম্যকভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবো।

মানসিক স্থিরতা লাভের এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। স্বচ্ছ ধারণা এবং মনোযোগের সাথে ভাবনার অভ্যাস করলে শক্তির চর্চা যথাযথভাবে করা যায়। আমরা যা-কিছুই ভাবি এবং করি না কেন, সবসময়ই দেখা যায়, মানুষের আচার ও বিশ্বাসের কোনো নিত্যতা নেই, কেবলই সত্যের নিত্যতা আছে। এটা মাথায় রেখেই ঐকান্তিক ইচ্ছা, জ্ঞান এবং শ্রম, এই তিনের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ অন্বেষণ করতে হয়।

সুশান্ত পাল ।। উপ-কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top