বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Rupali Bank


বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভুবন বিজয়ী ভাষণ


প্রকাশিত:
৮ মার্চ ২০২৩ ০১:০৬

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৯:০৮

ছবি সংগৃহিত

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে তৃণমূল স্তর থেকে দেশের সর্বস্তরে বাঙালি সংস্কৃতি কেন্দ্র করে এক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। এমনই ভাব আবহে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।

বাঙালিরা হয়ে উঠে উৎফুল্ল, পক্ষান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হয়ে পড়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তারা উপলব্ধি করে, ধীরে ধীরে তাদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। সেই অধিবেশনে পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও মৌখিকভাবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এর পুরো বিষয়ই ছিল লোক দেখানো।

যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, পর্দার আড়ালে নির্বাচনের রায় বানচাল করা। অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন তার সকল নীল নকশা তৈরি করা। এই নীল নকশার অন্যতম কারিগর ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই দিন পূর্বে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। অধিবেশন স্থগিতকরণের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ছাত্রসহ সর্বস্তরের বাঙালি জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

তারা এর প্রতিবাদে রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পাকিস্তানি শাসকের বৈষম্যে বাঙালির মাঝে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতালের ডাক দেন।

কার্যত ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২ মার্চ রাতে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতা সেই কারফিউ ভঙ্গ করে। সেনাবাহিনী গুলি চালায়। প্রতিদিন শত শত লোক হতাহত হয়।

প্রতিবাদে প্রতিরোধে জেগে ওঠে বাঙালি সত্তা। সর্বস্তরের ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির মুক্তির জয়ধ্বনি 'জয় বাংলা'! এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ‘বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০১৮’ গ্রন্থে লেখেন—“১৯৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রসমাজের 'স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ', 'স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন', ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব বাংলার সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন বাঙালির জাতীয় উত্থানের স্বাক্ষর বহন করে।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ পালিত হয়। পূর্ব বাংলার সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, সেক্রেটারিয়েট, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক-বিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশ অমান্য ও অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি প্রশাসন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে।

বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন de facto বা কার্যত সরকার প্রধান। বঙ্গবন্ধুর আবাসস্থল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি পরিণত হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের অনুরূপ, অর্থাৎ সকল নির্দেশের উৎসস্থান।” [ড. হারুন-অর-রশিদ; মে ২০২১; পৃষ্ঠা - ২৬০-২৬১]

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সকাল থেকেই জমায়েত হতে থাকে লাখো জনতা। তাদের কণ্ঠে জয়ধ্বনি 'জয়বাংলা' এবং স্লোগান—'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

পাকিস্তানি শাসকের শোষণ-বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উপস্থিত রেসকোর্স ময়দানের বাঙালি জনসমুদ্র উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদান করলেন তার ১৮ মিনিটের এক কালজয়ী ভাষণ।

সেই তেজদীপ্ত ভাষণে পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসের সাথে বাঙালির স্বাধিকার লক্ষ্যে করণীয় তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন—'আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়—তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।

আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।'

‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়-হিন্দু- মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত জনতাকে সতর্ক করে বলেন যে, শত্রুরা নিজেদের মধ্যে ঢুকে আত্মকলহের প্রচেষ্টা করবে। বাংলায়-হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি বিভেদ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। তাই সকলকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। তা না হলে বাঙালি জাতিরই বদনাম হবে।

১৮ মিনিটের বক্তব্যের শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুনিপুণ কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে দেন। তিনি বাঙালিকে কোনো শত্রুর ফাঁদে না পড়ে বুঝে শুনে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেন। তিনি প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। সুস্পষ্টভাবে বলেন, যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। কারণ এবারের সংগ্রাম বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

‘বাঙালিরা বুঝে সুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রাম, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়াবো। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে একটি অনন্য ভাষণ। ভাষণটি আজ মানবসভ্যতার অমূল্য সম্পদ।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field, We Shall Fight on the Beaches : The Speeches That Inspired History, (London 2013) শিরোনামে মানবজাতির ইতিহাসের ২৫০০ বছরের ৪১জন জাতীয় বীরের ভাষণ সংকলিত করেন। সেই সংকলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিষয়টি বাঙালির জন্য অত্যন্ত গর্বের।

ভাষণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন—'বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণ থেকে উজ্জ্বল ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই ভাষণ নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে রাতারাতি সশস্ত্র করে তোলে। একটি ভাষণকে অবলম্বন করে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি জীবন উৎসর্গ ও কয়েক লাখ মা-বোন সম্ভ্রম বিসর্জন দেন।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে এই ভাষণ (বজ্রকণ্ঠ) রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করে। বলা যায়, এই একটি ভাষণ একটি জাতিরাষ্ট্র, বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো সম্প্রতি (৩০ অক্টোবর ২০১৭) এই ভাষণকে বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার'-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।' [ড. হারুন-অর-রশিদ; মে ২০২১; পৃষ্ঠা - ২৬৩]

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভুবনবিজয়ী ভাষণের প্রত্যেকটি বাক্য, প্রত্যেকটি শব্দই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। যে প্রেরণার জ্যোতির্ময় পথেই উদিত হয়েছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য।

তথ্যঋণ :

১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ( সর্বশেষ সংশোধনীসহ)
২. ড. হারুন-অর-রশিদ, 'বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০১৮', অন্যপ্রকাশ, ঢাকা : মে ২০২১

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top