রবিবার, ১৭ই আগস্ট ২০২৫, ২রা ভাদ্র ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


স্বাধীনতার ৭৮ বছর

বাতিল করা হচ্ছে নাগরিকত্ব, ভারতে মুসলিমদের অস্তিত্ব সংকটে


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২৫ ১২:০৯

আপডেট:
১৭ আগস্ট ২০২৫ ২২:৫৬

ছবি ‍সংগৃহিত

প্রতি বছরের আগস্টে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস আসে ইতিহাসের প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিতে। ১৯৪৭ সালের রক্তাক্ত বিভাজনের মধ্যেও যারা পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতে থেকে গিয়েছিলেন, সেই সাড়ে তিন কোটি মুসলমানের কাছে ভারতের প্রতিশ্রুতি ছিল নাগরিক হিসেবে সমান সুযোগ-সুবিধা আর সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার।

আজ সেই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ কোটিতে— পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার বাস ভারতে। অনুমান করা হচ্ছে ২০৬০ সালের মধ্যে এটাই হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী।

কিন্তু সংখ্যার জোরেও মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রান্তিককরণের ভয় আরেকবার সত্য হয়ে উঠছে। ১৯৪০-এর দশকে মুসলিম লীগ সতর্ক করেছিল যে, “হিন্দু কংগ্রেস” পার্টির শাসনে ভারতের মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হবে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং টার্গেটেড সহিংসতা শিকার হবে। আজ সেই হুঁশিয়ারি যেন চোখের সামনে বাস্তব রূপ নিচ্ছে।

ভারতের জন্মলগ্নে যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ তা ভেঙে যায়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) প্রথমবার ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বের মানদণ্ড নিয়ে আসে। এরপর থেকে একের পর এক ঘটনায় ধর্মীয় বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভারতে।

মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমননীতি

কাশ্মিরের পেহেলগাম হামলার পর ভারতে “অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের” বিরুদ্ধে দমননীতি আরও জোরদার হয়েছে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লিসহ বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশ বহু বাংলাভাষী মুসলমানকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের অধিকাংশই দরিদ্র শ্রমিক। বিচারকের সামনে হাজির করার নিয়মও অনেক ক্ষেত্রে মানা হয়নি।

কাগজপত্রহীন মুসলমানদের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, অথচ অমুসলিমদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। মূলত আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, যেসব ভারতীয় মুসলিমের কাছে নাগরিকত্বের পক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই, তাদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে।

ভারতের মতো এমন একটি দেশে যেখানে কোটি কোটি দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষের কাছে এই ধরনের কাগজপত্র নেই, সেখানে এটি এক ভয়াবহ হুমকি। অন্যদিকে, অমুসলিম যাদের কাছে কোনো কাগজপত্র নেই, তারা এই আইন অনুযায়ী নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে।

বিহারে আগামী নভেম্বরের মধ্যে আট কোটি ভোটারের কাগজপত্র ফের যাচাই করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছে, বিপুলসংখ্যক মুসলমান ভোটারকে “অবৈধ” বলে বাদ দেওয়া হতে পারে।

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এখন আর নির্বাচন কর্মকর্তা বা আদালতের তিরস্কারের বিষয় নয়। ২০২৪ সালের ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ঘোষণা করেছিল যে, তারা নবনির্বাচিত উড়িষ্যার বিজেপি সরকারের মতো “অবৈধ বাংলাদেশি”দের খুঁজে বের করার অভিযান চালাবে।

এটি ভারতের মূলনীতি থেকে একটি বিস্ময়কর বিচ্যুতি। এটি ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি দেওয়া নৈতিক, আইনি এবং সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যকার আর্থ-সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ফাটলকে রাষ্ট্রীয় নীতির হাতিয়ারে পরিণত করেছে।

রাজনীতিতে বিভাজন ও সংস্কৃতিতে বিদ্বেষ

ভারতের নির্বাচন কমিশন সাম্প্রদায়িক প্রচারণার বিরুদ্ধে কার্যত আর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহারে “অবৈধ বাংলাদেশি” চিহ্নিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলমানদের গ্রেপ্তার, আটক আর সীমান্তে “পুশব্যাক” বাড়ছে।

খবর অনুযায়ী, আটককৃতদের অনেকের কাছে পর্যাপ্ত নথিপত্র ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাদের দিনের পর দিন হেফাজতে রেখেছে। অনেককে জোরপূর্বক পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে ‘পুশ ব্যাক’ করা হয়েছে - যা এমন এক ধরনের নির্বাসন প্রক্রিয়া, যা ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক অভিবাসী আইন অনুসরণ করে হয় না।

অন্যদিকে, বলিউডেও মুসলমানদের নেতিবাচক চরিত্রে হাজির করা হচ্ছে। “দ্য কেরালা স্টোরি” ছবিকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হলেও ক্ষমতাসীনদের সমর্থন পেয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকে একটি হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয় স্কুলের পানির ট্যাংকে বিষ মেশানোর অভিযোগে। আর তারা সেটি করেছিল এক মুসলিম প্রধান শিক্ষককে ফাঁসাতে।

এমনকি উবার চালক বা ডেলিভারি কর্মীদের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা প্রতিদিনের বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। ধর্মীয় স্লোগান দিতে না চাইলে কাজ হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হয়।

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে এক বিবৃতিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, “একটি ঐক্যবদ্ধ ভারত মানে মুসলিমদের জন্য দাসত্ব এবং এই উপমহাদেশ জুড়ে সাম্রাজ্যবাদী বর্ণবাদী হিন্দুরাজত্বের সম্পূর্ণ আধিপত্য, আর হিন্দু কংগ্রেস এটিই অর্জন করতে চায়...।”

নিত্যদিনের বিদ্বেষ থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি

এই ঘটনাগুলো দৈনন্দিন ভারতীয় ধর্মান্ধতার সাধারণ সহিংসতাকেই প্রতিফলিত করে। এর সঙ্গে আমাদের যোগ করতে হবে বিগত কয়েক বছরের নীতিগত সহিংসতা। গরুর মাংস নিষিদ্ধকরণ, মুসলমান কসাইদের ওপর হামলা; তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর; পার্লামেন্ট এবং রাজ্য বিধানসভাগুলোতে মুসলমানদের হতাশাজনক প্রতিনিধিত্ব; সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অভিযুক্ত মুসলিমদের বাড়ি ও সম্পত্তি বেছে বেছে ভেঙে ফেলা; হিন্দু উৎসবের সময় মসজিদগুলোর বাইরে হিন্দু যুবকদের টিটকারি ও স্লোগান— সব মিলিয়ে মুসলমানদের কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া এক নীতি হিসেবে রূপ নিচ্ছে।

এমনটা অবশ্য একেবারে নতুন নয়। স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছর পর থেকেই উর্দু ভাষা বাদ দেওয়ার উদ্যোগে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব হতে শুরু করে। ১৯৫৩ সালে জওহরলাল নেহরুও এ নিয়ে চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তবে পার্থক্য হলো— তখন ভারত রাষ্ট্র বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এখন ভারত রাষ্ট্রই বিভাজনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।

১৯৫২ সালের প্রথম দিকে আঞ্জুমান-তারাক্কি-ই-উর্দু কর্তৃক আয়োজিত উর্দু আঞ্চলিক সম্মেলন আলোচনা চলাকালীন উত্তর প্রদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে উর্দু বিলুপ্ত করার বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা তুলে ধরেছিল।

জওহরলাল নেহেরু তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে লেখা প্রায় ৪০০টি চিঠির মধ্যে একটিতে উত্তর প্রদেশের সেইসব প্রচেষ্টার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, যা এমন একটি ভাষাকে সরিয়ে দিতে চাইছে যা “ভারতীয় সংস্কৃতি এবং চিন্তাধারাকে সমৃদ্ধ করেছে”।

১৯৫৩ সালের ১৬ জুলাইয়ের একই চিঠিতে নেহেরু বলেছিলেন, ভারতীয়রা তাদের ব্যর্থতাগুলোকে উপেক্ষা করতে থাকে, যা পরে “আমাদের ওপর চেপে বসে”। তিনি সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলার প্রতি তার মনোযোগের বিষয়ে লেখেন, “আমাদের সামাজিক দৃষ্টিকোণে সহজাতভাবে এমন কিছু আছে যা আমাদের বিভক্ত করে তোলে। সম্ভবত এটি বহু বছর ধরে বর্ণপ্রথার অধীনে কাজ করার ফল, যা আমাদের অসংখ্য ভাগে বিভক্ত করে। এর কারণ যাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে আমরা সামান্য উস্কানিতেই বিভক্ত হয়ে পড়ি এবং ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করি।”

১৯৫৩ এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সংজ্ঞাগত পার্থক্য হতে পারে বিভাজনমূলক প্রবণতা এবং সংকীর্ণতার প্রতি রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া।

মোদি ও নির্বাচনী প্রচারণা

২০২৪ সালের নির্বাচনী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুসলমানদের “অনুপ্রবেশকারী” বলে আখ্যা দেন। তিনি দাবি করেন, কংগ্রেস এদেরই প্রধান সুবিধাভোগী বানাতে চায়। এমনকি তিনি বলেন, হিন্দু নারীদের মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

কিন্তু সেই আসনেই বিজেপি পরাজিত হয়। ফয়েজাবাদ-অযোধ্যার আসনেও বিজেপির হার, যেখানে কিছুদিন আগেই রামমন্দির উদ্বোধন করেছিলেন মোদি।

ভারতীয় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ

এখন ভারতের মুসলমানরা ধীরে ধীরে নিজেদের দেশেই বহিরাগত হয়ে পড়ছে। নাগরিকত্ব, সাংস্কৃতিক অধিকার আর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ— সব দিক থেকেই সংকুচিত হচ্ছে তাদের জায়গা। দার্শনিক হান্না আরেন্ট সতর্ক করেছিলেন— যে নাগরিক রাজনৈতিক জীবনে অংশ নিতে পারে না, সে শুধু নিজের কণ্ঠ নয়, স্বাধীনতাও হারায়।

ভারতের বহু মুসলমানের কাছে সেই সতর্কবাণী আজ আর তত্ত্ব নয়, প্রতিদিনের বাস্তবতা। তাদের অধিকার একে একে খর্ব হচ্ছে, নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতিও ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে নিঃশব্দে।

তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডে এই নিবন্ধটি লিখেছেন মুম্বাই-ভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক কবিতা আইয়ার। তিনি ভারতের গ্রামীণ রাজনৈতিক অর্থনীতি, জলবায়ু এবং জেন্ডার ইস্যুতে লেখালেখি করে থাকেন।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top