যার হাত ধরে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেন অন্তত ১ কোটি মানুষ
প্রকাশিত:
২০ জানুয়ারী ২০২৫ ১৫:২৪
আপডেট:
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৩:২৮

আবদুর রহমান আস-সুমাইত। এ শতাব্দীর অন্যতম ইসলাম প্রচারক ও মানবসেবক। যার সততা, নিষ্ঠা ও সুন্দর চরিত্রে বিমোহিত হয়ে আফ্রিকার মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেন। কুয়েতের আল-কাবাস পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, সুমাইতের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা ডাইরেক্ট এইডের মাধ্যমে ১০ মিলিয়ন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
পেশায় চিকিৎসক হয়েও দ্বীন ও মানবতার সেবায় জীবনোৎসর্গ করেছিলেন সুমাইত। চাইলেই তিনি জন্মভূমি কুয়েতে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু উম্মাহ ও মানবতার প্রতি পরম মমত্ববোধ তাকে নিয়ে গিয়েছিল আফ্রিকার প্রত্যন্ত পথে প্রান্তরে। সেবামূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকা মহাদেশের মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি।
দারিদ্র্য বিমোচন, অনাথদের আশ্রয় দান, যুগোপযোগী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আফ্রিকানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা ছিল— শায়খ সুমাইতের পুরো জীবনের ধ্যানজ্ঞান।
আব্দুর রহমান আস-সুমাইত আফ্রিকা মুসলিম এজেন্সি (নতুন নাম, ডাইরেক্ট এইড) এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৭ থেকে ২০১৩ সালে মারা যাওয়া পর্যন্ত তিনি এর সেক্রেটারি-জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি কুয়েত রিলিফ এজেন্সিরও প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৮৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এর সিইও এবং কেনিয়াতে কুয়েত দূতাবাসের হেলথ অ্যাটাচের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন।
আল-সুমাইত প্রতিষ্ঠিত দাতব্য ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। মুসলিম স্টুডেন্টস সোসাইটি মন্ট্রিল শাখা, মালাউই মুসলিম কমিটি কুয়েত, কুয়েতি ত্রাণ কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক চ্যারিটি অথরিটি কুয়েত, আন্তর্জাতিক ইসলামিক কাউন্সিল ফর কল অ্যান্ড রিলিফ এবং রেসকিউ সোসাইটির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ইসলামিক কল অর্গানাইজেশন সুদান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ইয়েমেনের ট্রাস্টি কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়াও জাঞ্জিবার শিক্ষা অনুষদ ও কেনিয়া শরিয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। কুয়েত চ্যারিটি ওয়ার্ক স্টাডিজ সেন্টারের চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি কর্মরত ছিলেন।
তার প্রতিষ্ঠিত ডাইরেক্ট এইড প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সব আফ্রিকানের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটি এখন পর্যন্ত আফ্রিকার সর্ববৃহৎ দাতব্য সংস্থা। ২৯টি দেশে সংস্থাটি কার্যক্রম পরিচালনা করে। আফ্রিকানদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান সহজলভ্য করার জন্য কাজ হরদম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই সংস্থা।
আফ্রিকায় দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সংস্থাটি ১৬ হাজার ৪৯৫টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে চারটি মহাবিদ্যালয়, বহু সংখ্যক রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল, প্রকাশনা সংস্থা, ১২৪টি হাসপাতাল, ২১৪টি নারী স্বাবলম্বীকরণ কেন্দ্র, ২ হাজার ২০০ মসজিদ, নয় হাজার গভীর নলকূপ, বহু মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দাওয়াহ ও রিসার্চ সেন্টার প্রভৃতি। সংস্থাটি এ পর্যন্ত দশ হাজার এতিম শিশুর লালন পালন করেছে। এছাড়াও শায়খ সুমাইতের সম্পাদনায় যাত্রা শুরু করা অভিজাত ম্যাগাজিন আল-কাওসার আফ্রিকার দুঃখ-বেদনা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে অবিরত কাজ করে যাচ্ছে।
ড. আবদুর রহমান হামুদ আস-সুমাইত ১৫ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে কুয়েতের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সজ্জন, ধার্মিক, পরিশ্রমী ও অমায়িক ছিলেন। আফ্রিকার মানুষের বঞ্চনা ও তিতিক্ষার কথা তিনি শৈশবেই জানতে পেরেছিলেন। ভবিষ্যতে আফ্রিকায় কাজ করবেন ভেবে— তখন থেকে তিনি দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের মতো জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন। ইসলামের মহান নবী (স.), সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফদের সততা ও সাহসিকতাময় জীবন তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। এ মহামানবদের জীবনীপাঠ তার মাঝে অনাড়ম্বরতা, মানবসেবা ও কষ্টসহিষ্ণুতার গুণ এনে দিয়েছিল।
শায়খ সুমাইত মনে করতেন, শুধুমাত্র আরবের ধনাঢ্য মুসলমানরা যথাযথভাবে জাকাত দিলেও পুরো মুসলিম বিশ্বকে দারিদ্র্য মুক্ত করা সম্ভব। কারণ, এর পরিমাণ কোনোভাবেই ৫৬ হাজার ৮৭৫ বিলিয়নের কম হবে না— যা পঁচিশ কোটি দরিদ্র মুসলমানের স্বাবলম্বী হওয়ার মৌলিক পুঁজি হিসেবে যথেষ্ট।
শায়খ সুমাইত দাওয়াহ ও দাতব্য কাজে তার অভিজ্ঞতাগুলো লিখে গেছেন ডজনখানেক বইতে। তোমার সকাশে আফ্রিকা, আফ্রিকায় কল্যাণের সফর, ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার কিছু চিত্র… একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা, মাদাগাস্কারের এন্তিমারো উপজাতি, আফ্রিকার কান্না এমনই কিছু বই। এছাড়াও পত্র পত্রিকায় তার অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে অনন্য অবদানের জন্য শায়খ সুমাইত বাদশা ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কারটির অর্থমূল্য সাড়ে সাত লক্ষ সৌদি রিয়াল পুরোটাই তিনি আফ্রিকার জন্য ওয়াকফ করে দেন। ২০১০ সালে তিনি দাতব্য কাজের জন্য শারজার ফারেস পদক লাভ করেন। একই বছর তিনি কাতার ফাউন্ডেশন ও দুবাইয়ের পক্ষ থেকে মানবসেবা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও বেনিনের রাষ্ট্রপতি পদক, কুয়েতের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক, সুদান, আজমান ও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। ২০০৩ সালে সুদানের বিখ্যাত উম্মে দারমান বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
তার সম্পর্কে আল-জাজিরা নেটওয়ার্কের সাবেক পরিচালক খনফার ওয়াদ্দাহ বলেছেন, ‘আফ্রিকায় আমি ১১টি বছর কাটিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি— সবাইকে দেখেছি, শায়খ সুমাইতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে।’
কুয়েতে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা আস-সুমাইত দাতব্য কাজে জড়িত হওয়ার আগে অভ্যন্তরীণ ওষুধ এবং গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন এবং সার্জারিতে বিএস, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগে ডিপ্লোমাসহ স্নাতক হন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন, অভ্যন্তরীণ ওষুধ এবং পাচনতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ। সুমাইত ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ মংট্রিয়াল সরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
আস-সুমাইত জীবনে দুবার কারাবরণ করেন। প্রথমটি ১৯৭০ সালে বাগদাদে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে যখন তিনি কুয়েতে ইরাকি আক্রমণের সময় ইরাকি গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। তাকে বাগদাদে পাঠানো হয় এবং তার ওপর কঠোর নির্যাতন চালানো হয়। পরবর্তীকালে তার জীবনে এই ভয়ানক অগ্নিপরীক্ষার দিকে ফিরে তাকালে তিনি বলেছিলেন- ‘আমার কোনো সন্দেহ ছিল না যে আল্লাহ আমার জন্য নির্ধারিত মুহূর্ত ব্যতীত আমি মারা যাব না।’ ১৫ই আগস্ট ২০১৩ সালে হৃদরোগের জটিলতায় ইন্তেকাল করেন বিশ্ববিখ্যাত এ দাঈ। শায়খ সুমাইতের কীর্তিময় জীবন যুগ-যুগান্তরে পৃথিবীর সব মানবসেবীকে নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করে যাবে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: