চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্রে যেসব ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে
প্রকাশিত:
৪ জুলাই ২০২৫ ১০:৩২
আপডেট:
৪ জুলাই ২০২৫ ১৯:৩৮

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে উত্তাল ও ভয়াবহ দিন ছিল ৫ আগস্ট। এদিন ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত রমনা জোনের সাবেক এডিসির নির্দেশে পুলিশ শুয়ে, বসে, কখনো হাঁটু গেড়ে, কখনো দাঁড়িয়ে একের পর এক গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে। গুলিতে শহীদ হন আন্দোলনকারীরা।
হত্যার পর পুলিশ সদস্যরা উচ্চৈঃস্বরে বলেন- ‘গুলি লাগছে, লাগছে’ ‘শেষ’ ‘মরছে, মরছে’ বলে মৃত্যু নিশ্চিতের পর উল্লাস করেন। এদিন চানখাঁরপুল এলাকায় শহীদ হন শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া। এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গুলি করে হত্যার ভয়াবহ সব তথ্য উঠে এসেছে। মামলায় কনস্টেবল অজয় ঘোষকে অন্যতম সাক্ষী করা হয়েছে।
জানা গেছে, সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিল আটকাতে চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। তখন চাইনিজ রাইফেল হাতে অন্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল অজয় ঘোষ। ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ সত্ত্বেও তিনি অপ্রয়োজনে গুলি চালাতে অস্বীকার করেন। এতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম আখতারুল ইসলাম কনস্টেবল অজয় ঘোষকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন এবং হুমকি দেন। এরপরও কনস্টেবল অজয় ঘোষ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না করলে, তার কাছ থেকে চাইনিজ রাইফেলটি কেড়ে নেন আখতারুল। তিনি সেই রাইফেল কনস্টেবল সুজন হোসেনের হাতে দিয়ে তাকে গুলির নির্দেশ দেন। তারপর কনস্টেবল সুজন হোসেন সেই রাইফেল দিয়ে কখনো শুয়ে, কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে একের পর এক গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে। একই ভাবে আখতারুল ইসলাম অন্যান্য পুলিশ সদস্যদেরকেও হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন।
বৃহস্পতিবার এই মামলার চার আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে (ডিসচার্জ) পৃথক আবেদনের ওপর উভয়পক্ষের শুনানি হয়। শুনানি শেষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশের জন্য ১৪ জুলাই তারিখ ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ) আটজনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানিতে বৃহস্পতিবার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। গ্রেফতার আসামি সাবেক ইন্সপেক্টর আরশাদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি, আসামি কনস্টেবল মো. সুজনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সিফাত মাহমুদ, আসামি কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিবলী সাদেকীন ও আসামি কনস্টেবল নাসিরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবুল হাসান। অন্যদিকে, পলাতক ৪ আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. কুতুবউদ্দিন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, বিএম সুলতান মাহমুদ ও গাজী এমএইচ তামিম।
চার আসামির পক্ষে শুনানিতে তাদের মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন জানান আইনজীবীরা। আইনজীবীরা বলেন, পুলিশ কনস্টেবল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মোতাবেক তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
জানতে চাইলে প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য কনস্টেবল অজয় ঘোষ তার হাতে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে অপ্রয়োজনে গুলি করতে অস্বীকার করেন। তার হাতে থাকা রাইফেলটি পুলিশের রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম আখতারুল ইসলাম কনস্টেবল সুজন হোসেনকে দেন। সেই রাইফেল দিয়ে গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে সুজন। এই মামলায় অজয় ঘোষকে সাক্ষী করা হয়েছে। তিনি বলেন, একইভাবে আখতারুল ইসলাম অন্যান্য পুলিশ সদস্যদেরকেও হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ) উঠে এসেছে সেদিনের মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা। এতে বলা হয়, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল। বৈষম্যবিরোধী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ মিছিল প্রতিহত করতে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। দুপুর অনুমান আড়াইটার দিকে কনস্টেবল সুজন হোসেন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন ও কনস্টেবল মো. নাসিরুল ইসলাম প্রাণঘাতী চাইনিজ রাইফেল দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নিরস্ত্র নিরীহ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের ওপর বিনা প্ররোচনায় গুলি করে হত্যা করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ৬ জনকে হত্যা করেন আসামিরা। চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালেরও ‘সম্পৃক্ততা’ রয়েছে। যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির তদন্ত চলছে, সেজন্য এই মামলায় তাদের আসামি করা হয়নি। তবে নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনায় যে তাদের ভূমিকা আছে, সেটার বর্ণনা এই চার্জশিটে রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, আন্দোলন দমন করতে ব্যবহার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র, এপিসি কার, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও বিপুল পরিমাণ বুলেট। পুলিশের এই অভিযানে নিহত হন শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদী হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া। পলাতক আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্য অভিযুক্তরা সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং অধীনস্তদের গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তাদের সহযোগিতা ও নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
এ মামলায় আট আসামির মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। মামলার অপর চার আসামি গ্রেফতার আছেন।
তারা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।
তাদের বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ২৯ জুন ট্রাইব্যুনালে এই আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আবেদন জানিয়েছিল প্রসিকিউশন। ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে এই মামলার ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়। সেদিনই অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: