মঙ্গলবার, ১২ই আগস্ট ২০২৫, ২৮শে শ্রাবণ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


ভারতে বাংলাদেশি পাটপণ্য রপ্তানি কি বন্ধ হওয়ার পথে?


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২৫ ১৮:৩৪

আপডেট:
১২ আগস্ট ২০২৫ ২২:২২

ছবি সংগৃহীত

ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে চার ধরনের পাটপণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করায় দেশটিতে বাংলাদেশি পাটপণ্য রপ্তানি কার্যত বন্ধ হয়ে গেল কি-না সেই প্রশ্ন উঠছে। এর আগে গত জুনে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর স্থলবন্দর ব্যবহার করে বেশ কিছু পাট ও পাটজাত পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করায় এমনিতেই বাংলাদেশি পাট রপ্তানি সংকুচিত হয়ে এসেছিল।

সোমবার ভারত নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, বাংলাদেশি এসব পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে হলে সমুদ্রপথে মুম্বাইয়ের নভসেবা বন্দর দিয়ে পাঠাতে হবে। যদিও সাশ্রয়ী হওয়ায় এসব পণ্যের প্রায় ৯৮ ভাগই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি হতো।

গত কয়েক বছর ধরে পোশাকের পর পাট ও পাটজাত পণ্যই ভারতে বেশি যাচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু এখন শুধু সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি কতটা অব্যাহত থাকে; তা নিয়ে উদ্বেগ আছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

পাটখাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে স্থলবন্দর ব্যবহার করে পাটপণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। তারা বলছেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তের ফলে যেটুকু পাটপণ্য ভারতে যাচ্ছিল সেটাও এবার প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

তবে ব্যবসায়ীদের একাংশ আবার মনে করেন, ভারত স্থলবন্দর ব্যবহার করে আমদানি নিষিদ্ধ করায় তাদের আমদানিকারকদের ব্যয় বাড়বে। এর ফলে পাটপণ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করছেন তারা।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় ভারতে বাংলাদেশি এসব পণ্যের চাহিদা কমবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদেরও পণ্য মূল্যে বেশি ছাড় দিয়ে রপ্তানি করতে হবে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রায় তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না।

• প্রজ্ঞাপনে যা বলেছে ভারত

সোমবার জারি করা এই প্রজ্ঞাপনে ভারত বলেছে, বাংলাদেশি চার ধরনের পাটপণ্য স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতে আমদানি করা যাবে না এবং এর ফলে কেবল মুম্বাইয়ের নভসেবা বন্দর দিয়ে এসব পণ্য আমদানি করতে হবে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাংলাদেশের যে চারটি পণ্যের ওপর ভারত আমদানি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সেগুলো হলো, পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের কাপড়, পাটের দড়ি বা রশি, পাটজাতীয় পণ্য দিয়ে তৈরি দড়ি বা রশি এবং পাটের বস্তা বা ব্যাগ।

ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য দপ্তরের এ সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে জুন মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ভারত।

তখন স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করা এসব বাংলাদেশি পণ্যে মূলত পাট ও পাটজাত পণ্য বেশি। এর মধ্যে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা, একাধিক ভাঁজের বোনা কাপড়, একক শণ সুতা, পাটের একক সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় রয়েছে এই তালিকায়।

ভারত এ ধরনের যে ৯টি পণ্যের ওপর স্থলবন্দর নিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে, এসব পণ্য থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ১৫ কোটি ডলারের কাছাকাছি, যার প্রায় সবটাই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়েছিল। রাজস্ব বোর্ডের হিসেবে, এই ১৫ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে মাত্র বিশ লাখ ডলারের রপ্তানি স্থলবন্দর দিয়ে হয়নি।

গত মে মাসে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়সহ কিছু পণ্যে আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল ভারত। তারও আগে এপ্রিলের শুরুতে ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল ভারত।

এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাছে চিঠি পাঠালেও ভারত সরকার তাতে কোনও সাড়া দেয়নি।

• প্রভাব কেমন হবে?

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত একের পর এক বিধিনিষেধ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ এখন সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠাতে হলেও সেগুলো কলম্বো বা সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে মুম্বাইয়ের বন্দরে যাবে।

ফলে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আবার পাটভিত্তিক শিল্প কলকাতা কেন্দ্রিক হওয়ায় বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য আবার মুম্বাই থেকে কলকাতা নিতে হবে। অথচ এতদিন বেনাপোল হয়ে সরাসরি কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ ছিল।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর ও রাজবাড়ী জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ শামসুল আবেদিন বলছেন, জুনের নিষেধাজ্ঞার পরেও কিছু পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে যাচ্ছিল, যা সোমবারের প্রজ্ঞাপনে বন্ধ হয়ে গেল।

‌‌তিনি বলেন, ‘‘আসলে যেটুকু যাচ্ছিল সেটাও বন্ধ করে দেয়া হলো। এতে আমাদের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে। আবার বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য নিয়ে নতুন করে পণ্য উৎপাদন করে তা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতো ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর ভারতে রপ্তানি হুমকির মুখে পড়ায় এমনি আমদানি কমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।’’

তবে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফরহাদ আহমেদ আকন্দ বলছেন, ভারত এতদিন তাদের রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিয়ে আসছিল বলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিল না।

‘‘এখন তাদের আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। ফলে তাদের জন্যই দাম বাড়বে। বেনাপোল দিয়ে নিলে তাদের এত খরচ বাড়তো না। তারা অন্য দেশে যেই পাটপণ্য বিক্রি করে সেসব জায়গায় বাংলাদেশের ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন বাজার সম্প্রসারণের জন্য একটি সুযোগ এসেছে।’’

প্রসঙ্গত, সাধারণত পাট কিংবা পাটপণ্য পরিবহনে খরচ এমনিতেই তুলনামূলক বেশি হয় বলে স্থলপথে ভারতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি উভয় পক্ষের জন্য সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হচ্ছিল। অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আমদানি করলে ভারতীয় উৎপাদকদের ব্যয় ও পণ্য মূল্য বাড়বে।

‘‘আবার এ খরচ বিবেচনায় নিলে কিছুটা মূল্য ছাড় দিতে হতে পারে রপ্তানিকারকদের। বাংলাদেশি পাটের মান ভালো হওয়ায় ভারতে এর চাহিদা আছে। ফলে ভারতের নতুন বিধি-নিষেধের ফলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কমবে কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে হয় না।’’

তার মতে, ভারতের এসব বিধিনিষেধের নেতিবাচক প্রভাব থাকবে। তবে এর সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আসা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

‘‘আমার ধারণা নির্বাচিত সরকার আসলে হয়তো নতুন করে এগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্থলপথে পণ্য রপ্তানি ও আমদানির পথ তৈরি হবে। এখন হয়তো সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেই। এ কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণ জরুরি।’’

পাট অধিদপ্তরের হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১২টি দেশে প্রায় ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকার কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছিল। এর মধ্যে ভারতেই রপ্তানি হয়েছে ৭০৯ কোটি টাকার পাট। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আজ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সচিবালয়ে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও ভারত সরকার তাতে কোনও সাড়া দেয়নি। বিবিসি বাংলা।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top