জোয়ার-ভাটার পানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বলছে অর্ধশতাধিক লাইট
প্রকাশিত:
১৩ আগস্ট ২০২৫ ১৭:০৬
আপডেট:
১৩ আগস্ট ২০২৫ ১৯:০০

বরগুনায় নদীর জোয়ার-ভাটার সময় স্লুইস গেট দিয়ে পানি প্রবেশের স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তাক লাগিয়েছেন মো. মনিরুল ইসলাম নামে এক উদ্ভাবক। তার এমন উদ্ভাবনকৃত বিদ্যুতে একসঙ্গে জ্বলছে প্রায় অর্ধশতাধিক বৈদ্যুতিক লাইট। তিন মাসের প্রচেষ্টায় নদীর পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। মনিরুলের এ সফল উদ্ভাবনে এলাকাবাসী গর্বিত ও আনন্দিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনিরুল ইসলাম বরগুনা সদর উপজেলার ৬নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা নামক এলাকার বাসিন্দা। তিনি ওই এলাকার স্থানীয় বাজারের একজন জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ী। ২০০৬ সাল থেকে তার ব্যবসার পাশাপাশি প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনমূলক গবেষণা শুরু করেন। সর্বশেষ তিন মাসের চেষ্টায় সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তায় মাত্র ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করে লোহা দিয়ে কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি করেন তিনি। পরে পায়রা নদীতে থাকা একটি স্লুইস গেটে সেগুলো স্থাপন করেন মনিরুল। আর সেখান থেকেই এখন জোয়ারের পানি প্রবাহের স্রোতের মাধ্যমে সফলভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন তিনি।
সরেজমিনে সদর উপজেলার পুরাকাটা এলাকার পায়রা নদীর সঙ্গে থাকা স্লুইস গেটটি ঘুরে দেখা যায়, জোয়ারের সময় পায়রা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে স্লুইসের মাধ্যমে ছোট নদী ও খালে পানি প্রবেশ করছে। আর এ পানি প্রবাহের সময় সৃষ্ট স্রোতকে কাজে লাগাতে স্লুইস গেটের মুখে লোহার তৈরি নিজের উদ্ভাবিত বিশেষ ধরনের একটি ফ্যান বসিয়েছেন মনিরুল। পানির স্রোতের ধাক্কায় ওই ফ্যান ঘুরলেই তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। এছাড়াও স্বল্প পরিসরে উদ্ভাবিত বিদ্যুতের মাধ্যমেই স্লুইস গেটটির পাশে একসঙ্গে তিনি জ্বালিয়েছেন অর্ধশতাধিক বৈদ্যুতিক লাইট। যা দেখতে ভিড় করছেন পথচারী ও স্থানীয়রা।
এমন উদ্ভাবন দেখে স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের দাবি, মনিরুল তার উদ্ভাবন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে দেশের জন্য সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবেন। বিশেষ করে কম খরচে উপকূলের নদী এলকার বিভিন্ন মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে তার এ উদ্ভাবন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন তারা।
পুরকাটা এলাকার বাসিন্দা মনিরুলের প্রতিবেশী মো. কামাল হোসেন বলেন, মনিরুল আমার বাল্যবন্ধু হওয়ায় তার এ বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতো। তবে এ কাজ সম্ভব না মনে করে তার কথার কোনো গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু মনিরুল থেমে থাকেনি। গবেষণা করতে গিয়ে লাখ লাখ টাকাও খরচ করেছে সে। তবে তার একান্ত প্রচেষ্টার ফলে জ্বালানিবিহীন বিদ্যুৎ উৎপাদনে সে সফল হয়েছে। তার এ উদ্ভাবন যদি সরাকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারে, তাহলে শুধু বরগুনা নয়, ধীরে ধীরে পুরো দেশ জ্বালানিবিহীন এ বিদ্যুতে আলোকিত হবে।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা পরিমল চন্দ্র শীল বলেন, জোয়ার ভাটার পানির স্রোত দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা শুনে আমাদের কাছে অকল্পনীয় এবং অবাস্তব মনে হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ঘাটাঘাটি করে মনিরুল তা বাস্তবে পরিণত করেছেন। মনিরুলের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। যদি তাকে সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা করা হয়, তাহলে তার এ উদ্ভাবনের মাধ্যমে উপকূলের যারা এখনো বিদ্যুৎ পায়নি তাদের প্রত্যেকের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
স্বামীর সফলতার বিষয়ে মনিরুলের স্ত্রী মোসা. তাসলিমা বেগম বলেন, জোয়ার ভাটার পানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব তা কখনোই ভাবতে পারিনি। তবে আমার স্বামীর দীর্ঘদিনের চেষ্টায় তিনি তা সফল করেছেন। তার এ কাজে সরকারি সহযোগিতা পেলে তিনি ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করতে পারবেন।
প্রতিদিন নদীতে দুইবার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। আর এ ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব জানিয়ে উদ্ভাবক মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০০৬ সাল থেকে দেশ প্রেম থেকেই বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী চিন্তা শুরু করেছি। পরে জ্বালানি তেল কেনার খরচ বাঁচাতে নদীর জোয়ার ভাটাকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে কাজ করতে শুরু করি। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে মাধ্যম তৈরি করেছি তাতে নদীর পানির উচ্চতা ৫ ফুট ব্যবধান হলেই পানির স্রোতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তবে আরেকটু সংযোজন করলে মাত্র ৩ ফুট উচ্চতার ব্যবধানেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এ উদ্ভাবনটি যদি মানুষের মাঝে প্রকাশ করা যায় তাহলে এক সময় জলবিদ্যুৎ দিয়ে পুরো বাংলাদেশ আলোকিত করা সম্ভব হবে। এছাড়াও বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি তেল এবং কয়লা ব্যবহারে যে খরচ হতো তাও হবে না। একবার শুধু জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ স্থাপন করলেই ব্যয়হীনভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সফল হতে কতদিন সময় লেগেছে এবং কী ধরনের ব্যয় হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা চালালেও তিন মাসের চেষ্টায় নাদীর জোয়ার ভাটাকে ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সফল হয়েছি। ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ করে লোহার অ্যাঙ্গেল ও লোহার প্লেট দিয়ে একটি ফ্যান এবং স্ট্রাকচার তৈরি করেছি। পানির চাপে লোহার ওই ফ্যান ঘুরলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মনিরুল বলেন, যেহেতু এটি একটি জলবিদ্যুৎ, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নদীতে সরকারের সহযোগিতা পেলে এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। আমার প্রকল্পটি যদি যুক্তিসঙ্গত এবং বিজ্ঞানসম্মত হয় তাহলে চাইলেই জ্বালানি ছাড়া ব্যয়হীন জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে আলোকিত করা যাবে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বরিশাল জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল গ্যাসসহ যা যা প্রয়োজন হয় এর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া বাকি সব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি সবই ব্যয়বহুল। এছাড়া গ্যাসের মজুতও ধীরে ধীরে কমবে। তবে যদি প্রাকৃতিকভাবে সৌর, বায়ু এবং পানির শক্তিকে ব্যবহার উপযোগী করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তাহলে জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশই বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে। আমাদের দেশেও প্রাকৃতিক যেসব উৎস আছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে সরকারের দিক থেকেও পরিকল্পনা রয়েছে, পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও সোলার, বায়ু এবং পানি যেখানে যা সম্ভব সেগুলো ব্যবহার করা প্রয়োজন।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: