মঙ্গলবার, ১২ই আগস্ট ২০২৫, ২৮শে শ্রাবণ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


দুই হাত নেই, তবুও সব শ্রেণিতে প্রথম আরাফাত


প্রকাশিত:
২৮ মার্চ ২০২৩ ২১:২৯

আপডেট:
১২ আগস্ট ২০২৫ ০৯:১৬

ছবি সংগৃহিত

জন্ম থেকেই দুই হাত নেই ১১ বছর বয়সী আরাফাতের। এই প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তাকে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে পড়াশোনার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ। কনুই দিয়ে লিখে প্রাথমিকের লেখাপড়া শেষ করে এবার মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে সে। শুধু তাই নয়! প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব ক্লাসে এখন পর্যন্ত প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে আরাফাত। প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায় পেয়েছে জিপিএ-৫।

ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার বলুহর গ্রামের আল আমিন মল্লিক ও সেলিনা দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আরাফাত। দক্ষিণ বলুহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের লেখাপড়া শেষ করেছে সে। বর্তমানে সে কোটচাঁদপুর সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ক শাখায় পড়ছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ১৮০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তি হয়েছে আরাফাত।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আরাফাত সকালে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। হাত না থাকায় কনুই দিয়েই লিখছে সে। একা গোসল করতে পারলেও কাপড় পরতে তাকে মায়ের সহযোগিতা নিতে হয়। কনুই দিয়ে কষ্ট করে নিজেই ভাত খায় সে। একাই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। ক্লাসেও অন্য শিক্ষার্থীদের মতো স্বাভাবিকভাবে বোর্ডে লিখতে পারে সে।

আরাফাতের মা সেলিনা খাতুন বলেন, আরাফাত আমাদের প্রথম সন্তান। যখন জন্মগ্রহণ করে তখন ওর এমন অবস্থা দেখে খুবই হতাশ এবং মর্মাহত হই। তখন আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিকভাবে ওর পরিচর্যা করে বড় করতে থাকি। কিন্তু অন্য সাধারণ বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না আরাফাত।

খেলাধুলাসহ অন্য কোনো কাজ করতে পারে না। ওর মাঝে আমি লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখি। তাই তাড়াতাড়ি স্কুলে ভর্তি করি। স্কুলের শিক্ষকরাও ওকে আগ্রহ করে স্কুলে ভর্তি নেয়। শিক্ষকরাও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। ছেলেটিও অনেক আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়া করে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সন্তান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে, সরকারি বড় অফিসার হবে। মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের সেবা করবে এটাই আমাদের আশা।

আরাফাতের বাবা আল আমিন মল্লিক বলেন, জন্ম থেকেই আরাফাতের দুই হাতের কনুইয়ের নিচের অংশ নেই। আঙুল না থাকায় স্বাভাবিকভাবে কিছু ধরতে পারত না। তবে কনুই দিয়ে লিখে প্রাথমিকের পড়া শেষ করে এবার মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে সে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ক্লাসে সে দ্বিতীয় হয়নি। তাকে নিয়ে অনেক আশা আছে আমাদের। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সহযোগিতা ওর জন্য খুবই প্রয়োজন।

আরাফাতের ৬ ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষিকা রেহেনা পারভিন জানান, আরাফাতকে দেখে প্রথমে অনেক খারাপ লেগেছিল। পরে ওর লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে খুব ভালো লেগেছে। সে নিয়মিত স্কুলে আসে। প্রতিদিনের পড়া অন্যদের থেকে ভালোভাবে জমা দেয়।

আরাফাতের সহপাঠীরা জানান, আরাফাত নিজেই নিজের কাজ করতে পারে। পড়ালেখার প্রতি ওর অনেক আগ্রহ। ছাত্র হিসেবে সে অনেক ভালো। কখনোই ক্লাস বাদ দেয় না। পড়ার প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ। সবাই সহযোগিতা করলে সে অনেক ভালো কিছু করবে।

মেধাবী আরাফাত বলে, আমি নিজের কাজগুলো দুই হাতের কনুই দিয়ে করি। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, হাতের লেখা, খাতায় অঙ্ক করা, গোসল করা, খাবার খাওয়া সবাই নিজে নিজে করি। তবে মাঝে মাঝে স্কুলে দেরি হয়ে গেলে মা-বাবার সহযোগিতা নেই। আমি তাদের ওপর নির্ভরশীল। স্কুলে অন্য বন্ধুদের মতো লিখতে গেলে একটু সমস্যা হয়। অন্যদের মতো দ্রুত লিখতে পারি না।

সে আরও বলে, এবার প্রাথমিকে আমার মেধাতালিকায় বৃত্তি পাওয়ার কথা ছিল। বৃত্তি পরীক্ষায় ৬০ মার্কের প্রশ্ন ছিল, তার মধ্যে ৫৫টির উত্তর দিতে পেরেছিলাম। বাকি ৪০ মার্কের লিখিত প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিয়েছি, কিন্তু আমি বৃত্তি পাইনি। তাই একটু কষ্ট পেয়েছি।

বড় হয়ে কী হতে চায় জানতে চাইলে আরাফাত বলে, পড়াশুনা শেষ করে সরকারি বড় অফিসার (ম্যাজিস্ট্রেট) হতে চাই। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে চাই। আমার মতো প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

কোটচাঁদপুর সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুর রহমান বলেন, আরাফাত পুরো স্কুলের মধ্যে ব্যতিক্রমী একজন মেধাবী ছাত্র। এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। তার চেষ্টা সবাইকে অবাক করে। স্বাভাবিকভাবে যেন সে বেড়ে উঠতে পারে তার জন্য সব শিক্ষক ও তার সহপাঠীদের সতর্ক করা আছে। এছাড়াও তার জন্য বিশেষ দুটি উপবৃত্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। তার লেখাপড়ার জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে অব্যাহত থাকবে।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দূরত্বের কারণে শহরের স্কুলে পড়ালেখা করতে চায় না। কিন্তু আরাফাত প্রতিবন্ধী হয়েও ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের স্কুলে পড়তে আসে। তার স্কুলের অন্য কোনো ছেলে-মেয়ে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়নি, শুধু আরাফাত ভর্তি হয়েছে। স্কুলে যাতায়াতের ব্যাপারে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়েছে, আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top