সোমবার, ২৩শে জুন ২০২৫, ৯ই আষাঢ় ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছেই


প্রকাশিত:
২৩ জুন ২০২৫ ১৬:১৪

আপডেট:
২৩ জুন ২০২৫ ২০:১০

ছবি সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যাংক খাত এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে মন্দ ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। কারণ মন্দ ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি এড়াতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকগুলোর মুনাফা কম হওয়ায় ও মন্দ ঋণ বাড়ায় প্রভিশনের চাহিদা বেড়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। এতে বেড়ে গেছে প্রভিশন ঘাটতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের মার্চে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে দাঁড়ায় এক লাখ ৬ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।

ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন থাকলে ঝুঁকি কম থাকে। আর প্রভিশন ঘাটতি হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। গত বছরের মার্চে ৭৬ শতাংশ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ছিল। চলতি বছরের মার্চে তা কমে মাত্র ৩৮ শতাংশ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রয়েছে। অর্থাৎ ৬২ শতাংশ ঋণের বিপরীতে কোনো প্রভিশন নেই। ফলে ব্যাংকগুলোর ৬২ শতাংশ ঋণই ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ঝুঁকি সার্বিকভাবে ব্যাংকের ওপরে আঘাত করছে।

ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর আয় কম হওয়ার কারণে মুনাফা থেকে মূলধনে অর্থ স্থানান্তর করতে পারছে না। ফলে মূলধন বাড়ানো যাচ্ছে না।

এছাড়া প্রভিশন ঘাটতি থাকায় অনেক ব্যাংক রাইট শেয়ার বা বোনাস শেয়ার দিয়ে মূলধন ঘাটতি মেটাতে পারছে না। ফলে লুটপাটের শিকার বেশ কিছু ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়েছে।

২০০৫ সাল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে গড়ে মূলধন রাখার হার ডাবল ডিজিটে অর্থাৎ ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে কিছু ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল। গত ডিসেম্বরে এসে মূলধন রাখার হার স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্নে অর্থাৎ ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে পৌঁছেছে। মূলত খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ার কারণে মূলধন ঘাটতিও বেড়েছে।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও মূলধন কমার কারণে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পরিমাণ কমে গেছে। অনেক ব্যাংক নতুন পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে তাদের নতুন খাত থেকে আয়ও হচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংক আয়ও একেবারে তলানিতে নেমেছে। এর প্রভাবে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা যেমন প্রত্যাশিত মুনাফা পাচ্ছেন না; তেমনি আমানতকারীদের মুনাফা কম দিতে হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ দিতে হচ্ছে। যা সার্বিকভাবে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এখন পর্যন্ত যেসব ঋণ খেলাপি হচ্ছে তার বেশির ভাগই বাণিজ্যিক ঋণ। মেয়াদি ঋণ এখনো সেই হারে খেলাপি হওয়া শুরু হয়নি। মেয়াদি ঋণ খেলাপি হওয়া শুরু করলে খেলাপি ঋণের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের হাতে এখন পর্যন্ত চলমান ঋণের মধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বকেয়া ঋণে পরিণত হয়েছে। পরিশোধ না করা হলে তিন মাস পরই এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে লুটপাটের মাধ্যমে নেওয়া ঋণের সবই এখন খেলাপি হচ্ছে। এসব ঋণ দীর্ঘ সময় ধরে পরিশোধিত না হওয়ায় খেলাপি ঋণের তিনটি ধাপের মধ্যে শেষ ধাপে অর্থাৎ আদায় অযোগ্য কু-ঋণ বা মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে। এসব ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে বলে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে অর্জিত মুনাফা থেকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

যেভাবে মন্দ ঋণ বাড়ছে, সেভাবে মুনাফা বাড়ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। এতে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে। পাশাপাশি ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদও বেড়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী মূলধন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন কমে গেছে স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এতে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুর্নামের কারণে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা খরচ বেড়ে গিয়ে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ঋণের সুদের হার বাড়ছে ও ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের সিংহভাগই ছিল আদায় অযোগ্য। গত বছরের ডিসেম্বরে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ হচ্ছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৮১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে মন্দ ঋণ শতকরা হারে সামান্য কমলেও পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের আগের ধাপে অর্থাৎ বিশেষ হিসাবে রয়েছে আরও ৫০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার ঋণ। এগুলো পরিশোধ না করা হলে আগামী তিন মাসের মধ্যে খেলাপি ঋণের প্রথম ধাপ নিম্নমান ঋণে পরিণত হবে। বিশেষ হিসাবে কোনো ঋণ নাম লেখালেই তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এ খাতে আরোপ করা ৩ হাজার ৮১ কোটি টাকার সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারছে না।

বিশেষ থেকে নিম্নমান হিসাবে খেলাপি হলেই তার বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। আরও তিন মাস পর তা সন্দেহজনক ঋণে পরিণত হবে। তখন ৫০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে। মন্দ হিসাবে শ্রেণিকৃত হলে রাখতে হবে শতভাগ প্রভিশন।

সূত্র জানায়, এভাবে ব্যাংক খাতে লুটপাটের চিত্র যত প্রকাশ্যে আসছে, ব্যাংকগুলোর অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। লুটপাটের কারণে কয়েকটি ব্যাংক তো একেবারেই চলতে পারছে না। লুটের টাকা আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সেগুলোর প্রায় সবই বিদেশে পাচার করা হয়েছে।


তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লুটপাট বন্ধ হয়েছে। এখন ব্যাংক খাতে সংস্কার চলছে। কিন্তু লুটের কারণে যে টাকা বের হয়ে গেছে বা পাচার হয়েছে সেগুলো এখন প্রকাশ্যে আসায় এ খাতের নেতিবাচক চিত্র ফুটে ওঠছে। যা মানুষকে হতবাক করছে।


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top