বৈশ্বিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ
প্রকাশিত:
২১ জুন ২০২৫ ১২:৪৮
আপডেট:
২১ জুন ২০২৫ ১২:৫০

ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার সূচনা করেছে। বিশ্বব্যাপী শক্তির ভারসাম্য যখন নড়বড়ে, তখন এ ধরনের যুদ্ধ শুধু দু’টি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর প্রভাব পড়ে বহুদূরের দেশগুলোর অর্থনীতিতেও। বাংলাদেশ, একটি উন্নয়নশীল এবং বৈদেশিক নির্ভরশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে, এই যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। বরং বলা চলে- বহুমাত্রিক অভিঘাতের মুখে পড়তে পারে দেশটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যেও এই যুদ্ধ পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রভাব পড়ছে জ্বালানি পণ্যের ওপর। কারণ যুদ্ধের এই দামামায় কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে জ্বালানি পণ্য আমদানির গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেল হরমুজ প্রণালী। ফলে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি।
এতে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ও আমদানি-রফতানিতে বড় ধাক্কার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারে জটিলতা তৈরি হলে অনেক প্রবাসী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। আমদানি-রফতানি চেইন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েল- উভয় দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান তেল সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইরান বিশ্বের অন্যতম তেল রফতানিকারক দেশ এবং পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশাল পরিমাণ জ্বালানি পরিবাহিত হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম উর্ধ্বমুখী। এমনকি এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়েছে ১০-১৫ ডলার।
বাংলাদেশ বছরে গড়ে ৫-৭ বিলিয়ন ডলারের তেল ও গ্যাস আমদানি করে থাকে। এই জ্বালানি ব্যয় মূলত নির্ভর করে বিশ্ববাজারে দামের ওপর। দাম বেড়ে গেলে সরকারের ভর্তুকি বাড়ে কিংবা ঘাটতি সামলাতে জ্বালানি সরবরাহে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয়। এর প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন খরচ এবং শিল্প উৎপাদনের ওপর, যা সমগ্র অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও খরচের চাপ তৈরি করে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে সম্ভাব্য ঝুঁকি
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। প্রতিবছর গড়ে ২০-২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে, যার বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান—এসব দেশে লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা সংকট তৈরি হতে পারে। এতে কর্মসংস্থান হ্রাস, শ্রমিক ফেরত আসা কিংবা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে, যা টাকার মান এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে।
আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো আমদানি নির্ভর। খাদ্যশস্য, জ্বালানি, শিল্প কাঁচামাল, সার, ভোগ্যপণ্য—বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে জাহাজ চলাচলে বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধি হতে পারে, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালী ও লোহিত সাগর ঘিরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে।
এই পরিস্থিতিতে আমদানির খরচ বাড়বে, কাঁচামালের সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে এবং দেশের ভোক্তা বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে, যার ফলে আমদানি পণ্যের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রফতানি খাত ও তৈরি পোশাক শিল্পে চাপ
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান রফতানি খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি), যা বছরে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে দেয়। এই খাতও আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের ওপর নির্ভরশীল—বিশেষ করে কাঁচামাল, রঞ্জক, যন্ত্রপাতি ও যাতায়াত খরচের দিক থেকে।
যুদ্ধের ফলে যদি আন্তর্জাতিক শিপিং খাতে ব্যয় ও সময় বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা হয়তো সময়মতো পণ্য না পেলে অন্য দেশের দিকে ঝুঁকবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার কারণে অর্ডার কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকেই যায়।
দেশীয় মুদ্রাস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব
জ্বালানি, খাদ্য, পরিবহন- সবকিছুর দাম বাড়লে সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। বর্তমানেও দেশে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি- সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে, আমদানি ব্যয় ও বাজার অনিশ্চয়তার কারণে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধু দুটি দেশের রাজনৈতিক বিবাদ নয়- এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার এক সূচনা। বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, বৈদেশিক নির্ভরশীল দেশে এই প্রভাব বহুস্তরে পড়বে। জ্বালানি সংকট, রেমিট্যান্স ঝুঁকি, রপ্তানি হুমকি এবং মূল্যস্ফীতি- সব মিলিয়ে দেশ এখন এক কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখে।
মধ্যপ্রচ্যে যুদ্ধের ডামডোলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন স্টাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক। অর্থনীতির এই শিক্ষক ঢাকা মেইলকে বলেন, চলামন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে যে বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে তা সহজে বলে ফেলা কঠিন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক প্রভাব রয়েছে এতে। প্রথমেই বলতে হয়- ইরান ও ওমানের মাঝখানে যে হরমুজ প্রণালী তা নিয়ে। তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী যে সাতটি উপসাগরীয় দেশ রয়েছে তাদের যত তেল-গ্যাস হরমুজ প্রণালীর ভেতর দিয়ে গিয়ে এশিয়াতে যায়। বিশেষ করে জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াতে যায়। পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ এলএনজি আসে হরমুজ প্রণালী দিয়ে। ২০২৪ সালে আমরা দেখেছি এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল অতিক্রম করেছে। এটি একটি বড় এমাউন্ট। আর এই যুদ্ধের ফলে হরমুজ প্রণালী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। তার তো একটা প্রভাব আছেই।
অর্থনীতির এই বিশ্লেষক আরও বলেন, তেল ও এনার্জি হচ্ছে এমন কাঁচামাল যা সব ধরণের পণ্যের সরাসরি খরচ বাড়িয়ে দেয়। এবং এর বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। আমাদের বৈশ্বিক এনার্জি লাইফলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার ইফেক্ট (প্রভাব) বাংলাদেশের ওপরও সরাসরি পড়বে। সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে। এছাড়া আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি তারও দাম বেড়ে যাবে। চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এরা সরাই মিলে ৭০ শতাংশ এলএনজি নিয়ে আসে হরমুজ প্রণালী দিয়ে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে রেমিট্যান্স। আর আমাদের প্রবাসীদের বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে। প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসেও মধ্যপ্রাচ্য থেকেই। এই যুদ্ধের দামামায় যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা ঝুঁকির মধ্যে আছে, এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের মধ্যেও প্রভাব পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই যুদ্ধাবস্থায় রেমিট্যান্সের যে ফ্লো তা স্লথ হলে আমরা অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়ব। রিজার্ভ ঘাটতিতে পড়বে দেশ। এছাড়া আমাদের বাজেটে ১৫ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের কথা রয়েছে। এখানেও তার প্রভাব পড়বে। আবার অনেকে চাকরি হারিয়ে চলে আসতে হবে।
আমদানি-রফতানি খাতেও এর প্রভাব পড়বে। আমাদের শিপিং কস্ট বেড়ে যাবে। রুট পরিবর্তন করতে হবে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য ডেলিভারি করতে পারবো না। এতে বাজার হারানোর সম্ভাবনাও রয়েছে। এয়ার ট্রাভেলেও খরব বাড়বে। মূলকথা হচ্ছে এই যুদ্ধ আমাদের কখনও কল্যাণ বয়ে আনবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। যেহেতু বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। দেশে আমদানি পণ্যের অধিকাংশই জ্বালানি তেল, তাই পণ্যটির দাম বাড়লে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো শ্রমবাজার। এখানে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: