দুদকে একাধিক অভিযোগ
বেপরোয়া রাজউকের ইসমাইল
প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:১৯
আপডেট:
২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫১
ঝাড়ুদার হিসেবে ২০০৮ সালে রাজউকে যোগ দিয়েছিলেন মো. ইসমাইল হোসেন মিয়া। সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন অফিস সহায়ক। রাজউকে যোগদানের পর গত ১৬ বছরে দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন তিনি। তার ঠাট-বাট, চলন-বলনে রাজকীয় পরিবর্তন হয়েছে। তার সম্পদ এতোটাই বেড়েছে যে গ্রামের লোকজন তাকে রাজউকের বড় পদের কর্মকর্তা হিসেবে জানেন। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম করে টাকা কামানোর কারনে কাউকে মানুষ বলে মনে করেন না ইসমাইল। গেল ৪ বছরে তার নামে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। তবে; কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ইসমাইল এখন আরও বেপরোয়া।
সূত্র মতে, ২০২১ সালের ৩১ মার্চ ইসমাইল মিয়ার নামে প্রথম দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। নাম, পরিচয় ও স্বাক্ষরহীন ওই অভিযোগপত্রে ইসমাইলের অর্থ-বিত্ত-সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করে দ্রুত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান অভিযোগকারী।
এদিকে একই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জনৈক ব্যক্তি ইসমাইলের নামে দুদকে দায়ের করা অপর এক অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, “রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পিয়ন ইসমাইল মিয়ার বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে দুদকে পর পর দুইটি লিখিত অভিযোগ দাখিল স্বত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে অদ্যাবধি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। যে কারণে ইসমাইল মিয়া এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সে নিজেকে রাজউকের হর্তা-কর্তা ভাবছে। ইসমাইল মিয়া বিভিন্ন মহলে বলে বেড়াচ্ছে- কেউ আমার একটা পশমও ছিড়তে পারবে না। দুদকে বিভিন্ন জনের নামে এমন ভুরি ভুরি অভিযোগ জমা হয়। টাকা হলে দুদক কেনা যায়। পুলিশ, সাংবাদিক- সবই টাকা দিয়ে কেনা যায়। অতএব, আমার বিরুদ্ধে এমন ১০/২০টা অভিযোগ দিয়েও কোন লাভ নাই।”
দুদকে করা অভিযোগে ইসমাইল মিয়ার সম্পদের বিবরণ উল্লেখ করে অভিযোগকারী আরও বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানাধীন নয়াদিল গ্রামের বাসিন্দা মোঃ ইসমাইল মিয়া একজন রিক্সা চালকের ছেলে হয়েও রাজউকে চাকরি করে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। তার পিতার নাম মোঃ হারেছ মিয়া। রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় ব্লক-এ, রোড নং-৪, বাড়ি নং-২৮ এ স্ব-পরিবারে বসবাস করেন ইসমাইল। মালী হিসেবে রাজউকে চাকরি জীবন শুরু করে বর্তমানে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত আছেন তিনি। তবে তার চলাফেরা আর দাপট দেখে মনে হবে তিনি বড় পদের কোন কর্মকর্তা। রাজউকের যেকোন অবৈধ কাজ টাকা দিলে মুহূর্তেই সে বৈধ করে দেয়। রামপুরা, বনশ্রীসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতে তার ৭/৮টি ফ্ল্যাট আছে। নামে-বেনামে রাজধানীর পূর্বাচলসহ তার গ্রামের বাড়িতে ৫ তলা ফাউন্ডেশনসহ ২টি বাড়ী ও জমি রয়েছে। তার নিজস্ব প্রাইভেটকার রয়েছে। একাধিক মোটর সাইকেল ব্যবহার করেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কোটি টাকা মূল্যের একটি দিঘি ক্রয় করেছেন। এছাড়াও প্রায় ৩০ লক্ষ্য টাকা ব্যয় করে একটি অটো রিক্সার শো-রুম করেছেন।’
ইসমাইলের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা অভিযোগপত্রে নিরাপত্তারজনিত কারণে তিনি তার নাম পরিচয় গোপন রেখেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন অভিযোগকারী।
২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি ইসমাইল মিয়ার নামে দুদকে আরও একটি অভিযোগ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামের মো. রাসেল মিয়া। ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়- ‘ইসমাইলের বাবা পেশায় ছিলেন রিকশাচালক। দুর্নীতির দায়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়া রাজউকের এক কর্মচারীর হাত ধরে সেখানে মাস্টাররোলে চাকরি পান ইসমাইল। এরপর তিনি গ্রামে পুরনো বাড়ির কাছে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেন। ইসমাইলের রয়েছে একটি প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল। ঢাকার বনশ্রীর এ-ব্লকে একটি, বনানীতে একটি, ভূঁইয়াপাড়ায় দুটি ও নন্দীপাড়ায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। রাজধানীর মৌচাক মার্কেটে দুটি দোকান ও কক্সবাজারে একটি হোটেলের শেয়ার রয়েছে তার। এছাড়া স্ত্রী, শ্বশুরসহ নামে-বেনামে অনেক সম্পত্তি রয়েছে। আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নান্নু মিয়ার বাড়ি কেনার জন্য তিনি ৫০ লাখ টাকা বায়না করেন, যা পরে ফেরত নেন।’
ইসমাইলের বাড়ী নয়াদিল গ্রামের বাসিন্দা রংমিস্ত্রি মো. রুবেল বলেন, ‘মানুষ হিসেবে ইসমাইল বেশ ভালো। যেকোনো প্রয়োজনে তিনি গরিব-দুঃখীদের টাকা দিয়ে সহায়তা করেন।’ পুকুরপারে নির্মাণাধীন মসজিদটি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ধাপে ধাপে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ টাকা দিয়েছেন। পাশের মাদরাসাটিও উনার হাতে গড়া।’ ছোট পদে চাকরি করে এত টাকা পান কোথায়- এমন প্রশ্নে রুবেলের উত্তর, ‘ইসমাইল ভাই কোন পদে চাকরি করেন সেটা তো জানি না, এত খবরও নিই না।’
ইসমাইলের নয়াদিলের দোতলা বাড়ির নিচতলায় ‘ব্যাটারি মেলা অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইজি বাইকের শোরুম’। সাইনবোর্ডে ইসমাইল ও তাঁর এক বোন-জামাইয়ের মুঠোফোন নম্বর দেওয়া। ইসমাইলের এলাকার এক দোকানী জানান, প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইসমাইল হোসেন। এ বাড়ির একটু দূরে ইসমাইলের পুরনো বাড়ি। আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের সামনেও রয়েছে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, সামান্য পিয়ন পদের একজন ছাপোসা কর্মচারী ইসমাইল মিয়ার স্বেচ্ছাচারিতা, ঘুষ-দুর্নীতি এক কথায় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সে কাউকেই তোয়াক্কা করে না। তার চলাফেরা, হাব-ভাব দেখলে মনে হয় সে রাজউকের বড় কোন কর্মকর্তা! রাজউকে যোগদানের মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই বাড়ী-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক মোঃ ইসমাইল মিয়া।
এসব বিষয়ে ইসমাইল হোসেন মিয়ার মুঠোফোনে কল দিয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “অভিযোগ সম্পর্কে আমি জেনেছি। আমাকে দুদক থেকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে, আমি কয়েকবার দুদকে গিয়েও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে দেখা করে এসেছি। এই একই বিষয়ে গত কয়েকবছর বিভিন্ন সাংবাদিক আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। আমি এখন ক্লান্ত।” তিনি অরও বলেন, “অভিযোগে ঢাকার যেসব সম্পদের কথা বলা হয়েছে- সেগুলো ডাহা মিথ্যা। এলাকার পুকুরটি আমি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছি। পরিচিতজনদের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে মসজিদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার এমন উদারতাই এখন কাল হতে চলেছে।”
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: