মূল্যস্ফীতি কমলেও চালের একরোখা দামের চাপ
প্রকাশিত:
২৭ জুলাই ২০২৫ ১৩:৩৯
আপডেট:
২৭ জুলাই ২০২৫ ১৮:৪৮

দেশে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কমলেও সাধারণ মানুষের স্বস্তির পথ এখনো সহজ হয়নি। বিশেষ করে চালের দামের একরোখা ঊর্ধ্বগতি গড়পড়তা পরিবারিক ব্যয়ের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। জুন মাসে চালের ওপর নির্ভরশীলতা এবং এই এক পণ্যেই অর্ধেক খাদ্য খরচ চলে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।
তাদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি কমলেও চালসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। যা নীতিনির্ধারকদের জন্য সতর্কতার বার্তা।
জিইডির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুন মাসে খাবার খরচের প্রায় ৫১ শতাংশই গেছে শুধু চাল কেনায়। আর মাছ কেনায় খরচ হয়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ, একটি পরিবারের খাদ্য খরচের ৮৩ ভাগের বেশি চলে যাচ্ছে এই দুটি পণ্যে। অন্যদিকে ফল, তেল, দুধ এবং মাংসে খরচ হচ্ছে অনেকটাই কম, যা পুষ্টির বৈচিত্র্য হ্রাসে ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষণ বলছে, মে মাসে খাদ্যপণ্যে চালের অবদান ছিল ৪০ শতাংশ, যা জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। চালের জাতভেদে মূল্যস্ফীতির হারও ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঝারি চালের অবদান ছিল ২৫ শতাংশ, মোটা চালের ১৭.৮২ শতাংশ এবং তিনটি জাতের চালেই মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশের ঘর ছুঁয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধানের বাম্পার ফলন সত্ত্বেও বাজারে চালের দাম কমেনি বরং এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।
জিইডির ভাষ্যমতে, এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বহুমুখী কারণ। যেমন—সার, বীজ, শ্রমিক ও সেচের খরচ বৃদ্ধি, ফসল কাটার পর ধানের ২৬ শতাংশ ক্ষতি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় মজুতদারির প্রবণতা।
মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জিইডি জানিয়েছে, মোটা চালের দাম ২০২৪ সালের নভেম্বরে ছিল এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে সরবরাহ ঘাটতি প্রকৃত নাকি সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যর্থতা, তা নির্ণয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। কারণ, চাল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকার পরও দাম না কমার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।
চালের পাশাপাশি ইলিশ মাছ, বেগুন, সয়াবিন তেল এবং টমেটোর মতো পণ্যেও উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি রেকর্ড হয়েছে। যদিও সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি কমে ৮.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। যা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রথমবারের মতো ৯ শতাংশের নিচে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৩৯ শতাংশে, যা একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। তবু চালের একক আধিপত্য মূল্যস্ফীতির চাপকে পূর্ণ স্বস্তির পর্যায়ে আসতে দিচ্ছে না।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ছয় মাস ধরে ১০ শতাংশ নীতিগত রেপো রেট বজায় রেখেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে, যা মে মাসে ৭.১৫ শতাংশ এবং জুনে ৭.১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কঠোর আর্থিক অবস্থানের ফলে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানা সম্ভব হলেও অর্থনীতির গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও কিছু খাতে তা এখনও দ্বি-অঙ্কে রয়েছে। জুন মাসে অ্যালকোহল, তামাক, পোশাক ও পাদুকা, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বিবিধ খাতে মুদ্রাস্ফীতি ১১ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। খাদ্য খাতে অবদান কমে ৩৯ শতাংশে নামলেও আবাসন ও অন্যান্য সেবামূলক খাতে ব্যয় বেড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মূল্যস্ফীতি কমলেও মানুষের ভোগব্যয় কাঠামোতে বৈষম্য থেকে যাচ্ছে। যারা কম আয়ে জীবনযাপন করে, তাদের জন্য চালের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টিতে প্রভাব ফেলছে। এ বাস্তবতায় নীতিনির্ধারকদের উচিত চালের বাজারে মনিটরিং জোরদার করা এবং সম্ভাব্য চক্রকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ছাড়া খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তি আনা সম্ভব নয় বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এসএন /সীমা
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: