রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


সরকারের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ পোশাক খাতে


প্রকাশিত:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:২০

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ১১:০৬

ফাইল ছবি

রফতানি খাতে নগদ সহায়তা তুলে দেওয়ার আকস্মিক সিদ্ধান্তে রফতানির-প্রধান খাত পোশাক শিল্প সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন মালিকরা৷

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের ক্লাবে গেলে তখন আর নগদ সহায়তা রাখার সুযোগ থাকবে না৷ এরই অংশ হিসেবে নগদ সহায়তা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে৷

দেশের রফতানি আয়ের শতকরা ৮৪ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে৷ পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এটা করা যেত৷ কারণ, এই সময়ে ডলার সংকটসহ নানা কারণে পোশাক খাত চাপে আছে৷

বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা প্রজ্ঞাপনে বললেও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘নগদ সহায়তা ধীরে ধীরে কমবে৷ কিন্তু হঠাৎ করে একেবারে শূন্য করে দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে কোনো চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নাই৷’

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘এটা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত৷ সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সেভাবেই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে৷’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পোশাক খাতের পাঁচটি এইচএস কোডের পোশাক রফতানিতে আর নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে না৷ পণ্যগুলো হচ্ছে নিট কাপড়ের টি-শার্ট, শার্ট, ট্রাউজার, ওভেন কাপড়ের জ্যাকেট, ব্লেজার ইত্যাদি৷ আর রফতানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা চার শতাংশ থেকে কমিয়ে তিন শতাংশ করা হয়েছে৷ ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রফতানিকারকদের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে এক শতাংশ৷ পোশাক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার রফতানি প্রণোদনা চার শতাংশ বহাল রয়েছে৷ তৈরি পোশাক খাতে নতুন পণ্য বা নতুন বাজারে চার শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে তিন শতাংশ৷ নতুন বাজার থেকে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ এছাড়া তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশেষ নগদ সহায়তা এক শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫০ শতাংশ করা হয়েছে৷ জানুয়ারি মাস থেকেই এটা কার্যকরের কথা বলা হয়েছে৷

পোশাক শিল্প মালিকরা যা বলছেন-

যে পাঁচ ধরনের নিট ও ওভেন পণ্য থেকে নগদ সহায়তা পুরোপুরি তুলে দেয়া হয়েছে ওই ধরনের পণ্যই রফতানির শীর্ষে আছে৷ তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এমনিতেই যুদ্ধের কারণে পোশাকের অর্ডার কম৷ আর পাঁচ-ছয় মাস আগে আমরা অর্ডার নিয়েছি৷ নগদ সহায়তার ওপর ভিত্তি করেই আমরা দাম নির্ধারণ করেছি৷ এখন সেই দাম তো আর অ্যাডজাস্ট করা যাবে না৷ আমরা ক্ষতির মুখে পড়বো৷ আর এই সেক্টরে নতুন যারা আসতে চান তারা নিরুৎসাহিত হবেন৷’

তার কথা, ‘পাঁচটি আইটেমে নগদ সহায়তা পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু ওই পণ্যগুলো আমাদের মূল আইটেম এবং সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়৷ আর আমরা যে নতুন মার্কেট তৈরি করেছি, সেখানে আবার ধস নামবে৷ আমরা সংকটের সময় জাপান, ভারত ও অস্ট্রোলিয়ায় পোশাকের নতুন বাজার তৈরি করেছি৷ এই বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে৷’

তার কথা, ‘গ্যাস নেই, ডলারের দাম বেশি ফলে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে৷ সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে৷ উৎপাদনও কমে গেছে৷ নগদ সহায়তা উঠে গেলে উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে৷ তখন প্রতিযোগিতায় টেকা অনেক কঠিন হবে৷’

২০২৬ সালে নগদ সহায়তা তুলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘২০২৬ সালে এখনো তিন বছর বাকি আছে৷ সেটা আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ধাপে ধাপে তোলা যেত৷ কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথা না বলে এভাবে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পোশাক খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে৷’

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়৷ এই রফতানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬.৬৭ শতাংশ বেশি ৷ তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ভাগে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে৷ অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে দুই হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে৷ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০. ৮৪ শতাংশ৷

বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে নিট সেক্টর এবং ব্যাকওয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রির স্পিনিং মিলগুলো৷ আমরা যে পোশাক রফতানি করি, তার ৫৬ শতাংশ হলো নিট পোশাক৷ এই খাতে পুরোই নগদ সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে৷ এটাই আমাদের মূল উদ্বেগের বিষয়৷ অন্যান্য পোশাক থেকে বিভিন্ন হারে কমানো হয়েছে৷ আমাদের মনে হচ্ছে, কোনো একটি মহল সুকৌশলে নগদ সহায়তা কমানোর কথা বলে আসলে তুলে দিয়েছে৷’

তার কথা, ‘আমরা এই খাতের স্টেক হোল্ডার৷ আমাদের সঙ্গে কথা না বলে এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো৷ আমাদের সঙ্গে আলাপ করে কোন খাতে কীভাবে পর্যায়ক্রমে নগদ সহায়তা ২০২৬ সালের মধ্যে তুলে নেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো৷ সেটা সহনীয় হতো৷ আমরাও প্রস্তুতি নিতে পারতাম৷ কিন্তু এখন আমরা সংকটের মধ্যে পড়ে গেছি৷’

তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে প্রণোদনার সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাওনা আছি৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-হামাস সংকট, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলা- এসব কারণে বস্ত্রখাতে অর্ডার ৬০ ভাগ কমে গেছে৷ আর এখন নগদ সহায়তার ব্যাপারে এই সিদ্ধান্তের ফলে রফতানি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ উৎপাদন কমে যাবে৷ আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য আগেই আমাদের প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়৷ এখন যদি জানুয়ারি থেকে সেটা বাদ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা পোশাকের দাম কীভাবে নতুন করে ঠিক করবো!’

তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা বা প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে পোশাক কর্মীদের মজুরিসহ আরও অনেক সুবিধা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে৷ অনেকে চাকরি হারাতে পারেন৷ কারণ, প্রণোদনার অর্থ দিয়ে তাদের বেতন দেওয়া হয়৷’

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘পোশাক শিল্পে উৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক কারখানায় এখন ওভারটাইম নাই৷ ফলে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ নতুন মজুরি কাঠামো কিছু কারখানায় এখনো বাস্তবায়ন হয়নি৷ আমরা চাই সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক তা যেন শ্রমিকদের কল্যাণে হয়৷ শ্রমিকদের জন্য সরাসরি স্বল্পমূল্যে রেশন চালু এখন জরুরি৷’

প্রণোদনা থাকবে না-

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘প্রণোদনা তুলে দেওয়া ভালো না খারাপ এই বিতর্কের এখন আর আমাদের সুযোগ নেই৷ আমাদের আইনি কাঠামোর দিক দিয়ে চিন্তা করতে হবে৷ এগুলো তুলে দিতে হবে৷ না দিলে ২০২৬ সালে আমাদের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী শাস্তির মুখে পড়তে হবে৷ তাই এই কাজে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন৷’

তার কথা, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে একবারে নয়, ধাপে ধাপে তুলে দেওয়া হচ্ছে৷ আমার বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য এটা যতদিন বেশি রাখা যায়, সেটা করা উচিত৷ পোশাক খাত এরই মধ্যে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করেছে৷ আর নগদ সহায়তার ব্যাপারে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, যারা এখান থেকে টাকাটা নিয়ে নেয়৷ ফলে এটা পর্যায়ক্রমে তুলে নিলে পোশাক খাতে বড় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না৷’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বাংলাদেশ যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে, এটা নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সরকার কথা বলেছে৷ কী করতে যাচ্ছে তার পরিকল্পনাও প্রকাশ হয়েছে৷ পোশাক শিল্পের মালিকরাও সেটা জানেন, তাদের প্রস্তুতিও আছে৷ কেউ যদি বলেন জানেন না সেটা ঠিক নয়৷’

হঠাৎ শূন্য করে দেওয়া নয়-

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘নগদ সহায়তা তো ধীরে ধীরে কমাতে হবে৷ ২০২৬ সালের মধ্যে তুলে দিতে হবে৷ তবে এইভাবে হঠাৎ করে শূন্য করে দেওয়ার ব্যাপারে আমার জানা মতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ বাংলাদেশ ব্যাংককে কোনো চিঠিও আমরা দিইনি৷ বৃহস্পতিবার আমাদের কী পরিকল্পনা তা পুরো জানাতে পারবো৷’

সব রফতানি খাতেই নগদ সহায়তা কমানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ তাতে প্রথম দফায় সব মিলিয়ে নগদ সহায়তা গড়ে ১০ ভাগের মতো কমছে৷ এরমধ্যে আছে চামড়া, পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, আসবাবপত্র, প্লাস্টিক পণ্য, হিমায়িত চিংড়ি, মোটরসাইকেল, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজসহ ৩০-৩৫ ধরনের পণ্য৷

 


সম্পর্কিত বিষয়:

পোশাক খাত বাংলাদেশ ব্যাংক

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top