পাকিস্তানি পণ্য ও বাণিজ্য রুটের ওপর নির্ভরতা কমাতে আফগান ব্যবসায়ীদের ৩ মাসের আল্টিমেটাম দিয়েছে আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকার। আফগানিস্তানের উপ প্রধানমন্ত্রী মোল্লা আবদুল গনি বারাদার এ তথ্য জানিয়েছেন।
আজ বুধবার রাজধানী কাবুলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে আফগান উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, “পাকিস্তান নিয়মিতভাবে তাদের বাণিজ্যরুটগুলো আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য বন্ধ রাখছে। এটা আমাদের দেশের মর্যাদার জন্য হানিকর। তাই আফগানিস্তানের বাণিজ্য, শিল্প এবং আফগানদের অধিকার সমুন্নত রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের বাৎসরিক বাণিজ্যের ভলিউম ১৭০ কোটি ডলারেরও বেশি। পাকিস্তান থেকে নিয়মিত কৃষিজ, জ্বালানি, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে আফগানিস্তান। পাকিস্তানও ফল, শাকসবজি, গমসহ বিভিন্ন কৃষিজ ও খাদ্য আমদানি করে আফগানিস্তান থেকে।
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার তোরখাম সীমান্ত ক্রসিংয়ের মাধ্যমে চলে দুই দেশের অধিকাংশ বাণিজ্য। অন্যান্য কয়েকটি সীমান্ত ক্রসিংও বাণিজ্যিক উদ্দেশে ব্যবহার করা হয়।
প্রতিবেশী এবং একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র আফগানিস্তানের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে তিক্ততা চলছে পাকিস্তানের। বর্তমানে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ২০২১ সালে তালেবান বাহিনী কাবুল দখল এবং সরকার প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে শুরু হয়েছে এ অবস্থা।
দুই দেশের মধ্যে তিক্ততার প্রধান কারণ পাকিস্তানের তালেবানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। কট্টর ইসলামপন্থি এই গোষ্ঠীটির ধারাবাহিক হামলায় গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে নিহত হয়েছেন কয়েক হাজার সামরিক ও বেসামরিক মানুষ। সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে বেশ কয়েক বছর আগে এই গোষ্ঠীটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান।
তবে এতে টিটিপির কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং কাবুলে তালেবান সরকার অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দিনকে দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে গোষ্ঠীটি। পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য খাইবার পাখতুনখোয়া টিটিপির প্রধান ঘাঁটি অঞ্চল। টিটিপির প্রধান লক্ষ্য খাইবার পাখতুনখোয়াকে পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্তমান আফগানিস্তানের আদলে একটি কট্টর ইসলামপন্থি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে টিটিপি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি।
খাইবার পাখতুনখোয়ার সঙ্গে সীমান্ত আছে আফগানিস্তানের। কাবুলে আসীন তালেবান সরকার নিয়মিত টিটিপিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদত দিচ্ছে বলে ২০২১ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার অভিাযোগ করেছে ইসলামাবাদ, তবে কাবুল বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত ৯ অক্টোবর রাতে কাবুলে বিমান অভিযান চালায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে নিহত হন টিটিপির শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ. দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ক্বারি সাইফুল্লাহ মেহসুদসহ টিটিপির বেশ কয়েক জন সম্মুখ সারির নেতা।
এ অভিযানের ২ দিন পর ১১ অক্টোবর খাইবার পাখতুনখোয়ার সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি সেনা চৌকিগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালায় আফগান সেনাবাহিনী। পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দেয়। ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলে এই সংঘাত। পাক সেনাবাহিনীর আন্ত:বিভাগ সংযোগ দপ্তর (আইএসপিআর)-এর তথ্য অনুসারে, সংঘাতে আফগান সেনাবাহিনীর ২ শতাধিক এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ জন যোদ্ধা নিহত হন।
এরপর ১৫ অক্টোবর প্রথমে কাতারের রাজধানী দোহা এবং পরে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির জন্য বৈঠক শুরু করেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সরকারি প্রতিনিধিরা। তবে আফগানিস্তান লিখিত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে না চাওয়ায় সেই বৈঠক ভেস্তে যায়।
এদিকে ৯ অক্টোবর থেকেই বন্ধ আছে তোরখাম সীমান্ত ক্রসিংসহ অন্যান্য সীমান্ত ক্রসিংগুলো। ফলে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও থেমে আছে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে।
পাকিস্তানের জাতীয় ব্যবসায়ী সংগঠন অল পাকিস্তান মার্কেটস ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মালিক সোহনি আজ বুধবার রাজধানী ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাণিজ্য ও সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে।
“শত শত ট্রাক ফল, শাকসবজি এবং অন্যান্য কৃষিজ পণ্য ক্রসিংয়ের ওপারে আটকে আছে। এসব পণ্যের বেশিরভাগই পচে গেছে। আর এদিকে পাকিস্তানের বাজারে ফল-শাকসবজির দাম বাড়ছে আর শত শত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে পাকিস্তানের ব্যবসায়ী সমাজ ও কোষাগার— উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”