দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। এসময় তিনি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে সরকারকে অনুরোধের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের দোসরদের কর্তৃক দেশে অরাজকতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কড়া হুশিয়ারি দেন। শিবির সভাপতি বলেন, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ এবং চাঁদাবাজ কোনটাকেই বরদাস্ত করা হবে না।
বুধবার (১২ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই হুশিয়ার দেন। সংবাদ সম্মেলনে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা, ছাত্ররাজনীতির সংস্কার, ফ্যাসিবাদী শাসনাবস্থা এবং চাঁদাবাজি-সহ সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানান এই শিবির নেতা।
শিবির সভাপতি বলেন, স্বাধীনতার পরে মানুষ এখনও নির্যাতন ও বৈষম্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়; গত কয়েক বছরে গড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভেঙে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হলেও এখনই পূর্ণ সংস্কার হয়নি। তিনি দাবি করেন, এই সংস্কারের অংশ হিসেবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্য আইনিভাবে সুরক্ষিত করতে দ্রুত গণভোট ও আইন প্রণয়ন জরুরি।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের শিকল ভেঙে আমরা নতুন বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক শক্তি এখনও পুরনো ফ্যাসিবাদী কাঠামো টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমরা এ ধরনের রাজনীতির তীব্র নিন্দা জানাই এবং দেশের ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করার অঙ্গীকার করছি।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও মানুষ এখনো সম্পূর্ণভাবে জুলুম ও নির্যাতনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়নি। এই কারণে দেশের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। হাজারো তরুণ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় দেশ রাজনৈতিকভাবে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এটি শুধু ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের প্রতীক নয়, বরং একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ছাত্ররাজনীতির সূচনা।
ছাত্ররাজনীতির সংস্কার এবং নির্বাচন প্রসঙ্গে
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেমিক, যোগ্য ও আদর্শ নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতির সংস্কার দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের প্রথম ধাপ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অর্জন রক্ষার পাশাপাশি এটি জাতীয় টেকসই রাজনৈতিক সংস্কারের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ তৈরি করবে। আমাদের লক্ষ্য একটি ফ্যাসিবাদমুক্ত, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা।
চাঁদাবাজি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা
সংবাদ সম্মেলনে জাহিদুল ইসলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি এবং সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পুরনো ঢাকায় ব্যবসায়ী সোহাগকে পাথর মেরে হত্যা, নারীদের ওপর হামলা, মসজিদে বাধা প্রদানের মতো ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ। সরকারের উদাসীনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপ্রতুল পদক্ষেপের কারণে জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সরকারকে সতর্ক করছি, এসব ফ্যাসিবাদী ও অরাজক কর্মকাণ্ড দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে দেশের ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করবে।
তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন নোয়াখালী, ফেনী, নওগাঁ ও ঝিনাইদহে নারীদের ওপর হামলা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সময় সহিংসতা। জাহিদুল ইসলাম বলেন, গণতান্ত্রিক ও নারীবান্ধব দাবি করা দলগুলোর নেতাকর্মীরা এই ধরনের সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না হওয়া দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। আমরা সতর্ক করছি- দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা কাউকে সহ্য করা হবে না।
গণমাধ্যম ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশের প্রতি আহ্বান
শিবির সভাপতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল গণমাধ্যম সবসময় দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। কিন্তু কিছু মিডিয়া এখনো একপাক্ষিক আচরণ করছে।
সাংবাদিকদের সহযোগিতামূলক মনোভাব কামনা করে শিবির সভাপতি বলেন, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে একপেশে সংবাদ পরিবেশন, রাজনৈতিক চাপ দেওয়া ও ব্যক্তিগত স্বার্থে গণমাধ্যম দখল করার মতো আচরণ চলবে না। এ ধরনের ঘটনায় দেশের গণতন্ত্র আবারও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও বিচার কার্যক্রম
জাহিদুল ইসলাম আগামীকাল ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে খুনি হাসিনার বিচারের রায়ের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। গত দুই দিনে তারা ১৫টির অধিক বাসে আগুন দিয়েছে, ময়মনসিংহে একজন বাসচালক নিহত হয়েছে। সরকারের উদাসীনতা এ ঘটনায় দায়ী। আমরা আহ্বান জানাচ্ছি- অগ্নিসন্ত্রাস, গুম, খুন, নির্যাতনসহ সকল ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হোক।
তিনি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে স্মরণ করিয়ে দেন, দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের পর আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এই বাংলাদেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রতিহিংসা, হীনম্মন্যতা ও কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি আবারও ফ্যাসিবাদী কাঠামো ফিরিয়ে আনতে পারে। তাই সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি- চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সহিংস মনোভাব পরিহার করে যৌক্তিক রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে।