হাসিনার পালানোর খবর প্রথম যেভাবে পেয়েছিলেন এএফপির শফিকুল
প্রকাশিত:
৫ আগস্ট ২০২৫ ১৮:৩১
আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২৫ ২১:১২

৫ আগস্ট ২০২৪— গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর প্রথম জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির ঢাকা প্রতিনিধি শফিকুল আলম।
এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, কীভাবে একজন নির্ভরযোগ্য সোর্সের কাছ থেকে দুপুর ১২টা ৪০ বা ৪৫ মিনিটের দিকে তিনি খবর পান, শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
‘৫ আগস্ট ২০২৪-এ আমি দুপুর ১২টা ৪০ বা ৪৫ মিনিটের দিকে আমার এক সোর্সকে ফোন দিলাম। তিনি আমাকে বললেন, শেখ হাসিনা রিজাইন করে পালিয়ে গেছেন। আমি তখন আমার বসকে ফোন দিলাম, আমার বস মানে হলো এএফপির সাউথ এশিয়ার প্রধান। ঘটনা বললাম, কিন্তু আমার বস বললেন, আমি এ রকম একটা সেনসিটিভ বিষয়ে সিঙ্গেল সোর্স ব্যবহার করে নিউজ তো দিতে পারব না। এতটা রিস্ক নেওয়া যায় না।
তখন আমি আবারও আমার সোর্সকে ফোন করলাম। তখন আমার সোর্স আমাকে ডিটেইল বলল যে এসএসএফের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে বলা হয়েছে যে তাদের কাছে খবর আসছে উত্তরা থেকে ৫ লাখ মানুষ আসতেছে আর শনির আখড়া থেকে আসতেছে সাড়ে ৩ লাখ মানুষ। এরা সবাই গণভবনে আক্রমণ করবে।
ফলে এত মানুষকে খুন করে তো আমরা আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারব না। অতএব আপনি বাকসো-পেটরা গোছান।’
তখন শেখ হাসিনা বললেন, ‘বিটিভিকে ডাকুন। আমার একটা বক্তব্য রেকর্ড করুক।
কিন্তু এসএসএফ তখন বলছে যে না সে সময় নাই। কারণ যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। কেননা আন্দোলনকারীরা কাছাকাছি চলে আসছে। তখন তিনি এসএসএফসহ প্রথমে এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেল যে এসএসএফের কাছে খবর এসেছে ততক্ষণে আন্দোলনকারীরা এয়ারপোর্টেও চলে এসেছে।
এ জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুরাতন এয়ারপোর্টে নেওয়া হয়েছে এবং তিনি সেখান থেকেই ভারতে পালিয়ে গেছেন। এ ঘটনা শোনার পর আমার বস বললেন—না, তুমি আরো কোনো সোর্সকে ধরো। না হলে এটা দেওয়া যাবে না। কারণ যদি তিনি আবার ফিরে আসেন। কিংবা যদি সেটা সঠিক না হয়।’
তখন আরেকজন সোর্সকে ধরলাম, তিনিও কনফার্ম করলেন। ততক্ষণে ১২টা ৫০ বা ১টা বোধ হয় বেজে গেছে। তখন আমরা সেটা আপ করলাম যে, শেখ হাসিনা ফ্লি ইন্ডিয়া। তখন তো সমস্ত পত্রিকা, টিভি আমাকে ফোন করতেছে। আমার অফিসে ফোন করতেছে। সব মিডিয়া তখন এএফপিকে সোর্স দেখিয়ে রিপোর্ট করতেছে। আমাকে ফোন করতেছে। বলতেছে ভাই এটা কি সত্য। দেখেন আপনাকে কিন্তু উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আবার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল, তারাও ফোন করতেছে এবং বলতেছে যে, শফিক দেখেন আবার ভুলটুল না হয়।
আমি তখন আসলে ভয় পেয়ে যাই। সুরা-কেরাত পড়া শুরু করে দিই। ভাবছিলাম, যদি আবার সে ফিরে আসে তখন কী হবে? আমি তখন টিভিতে চোখ রাখছি। কী হচ্ছে। কে কী দিচ্ছে। দেখলাম সবাই তখন এএফপির বরাত দিয়েই স্ক্রল দিচ্ছে। এরই মধ্যে একটা দুইটা বেজে গেছে। দেখলাম, তখন টিভিতে একটা ঘোষণা আসল যে, সেনাবাহিনী প্রধান টিভিতে ভাষণ দেবেন জাতির উদ্দেশে। তখন আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হলাম, স্বস্তি পেলাম। যেহেতু সে একটা ব্রুটাল ডিকটেটর ছিল। তার তো কোনো দয়া-মায়া নেই। ভয়ানক একটা মহিলা। তখন আমি আবার একজনকে ফোন দিয়েছি, বলল যে, হ্যাঁ জেনারেল ভাষণ দেবেন।
সেদিনের কথা আমি তো কখনোই ভুলব না। এটা আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় ও সেরা অর্জন। জুলাইয়ের ১৮ তারিখের পর তো সারা দেশে ইন্টারনেট তখন বন্ধ। কিন্তু আমার অফিসে হাই স্পিড ইন্টারনেট ছিল। ৫০/৬০ জন সাংবাদিক এখানে এসে কাজ করেছেন। আমি সবাইকে অ্যালাও করেছি। সবাই এখানে সাহায্য নিয়েছে। আবার তারাই আমার বিরোধিতা করেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আরাফাত ও হাসান মাহমুদকে গিয়ে বলেছে, শফিককে ধরেন। তখন তো আমাকে আবার অন্য জায়গা থেকে বলা হয়েছে আপনি সাবধানে থাকেন।
আমি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভীতু মানুষ। কিন্তু সে সময় আমার কোনো ভয় ছিল না। যখন বলা হলো, শেখ হাসিনা ছেলেদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু হান্নান মাসুদ আমাকে বলল যে, না, আমাদের দাবি তো মানেনি। আমরা তো তার পদত্যাগ চাই। আমি তখন ওটার একটা নিউজ করলাম যে, হাসিনার প্রস্তাব ছেলেরা প্রত্যাখ্যান করেছে। সেটা আন্তর্জাতিকভাবে হেভি কাভারেজ পেল। তখন আবার আমাকে বারবার বলা হলো, আওয়ামী লীগের লোকেরা নানান ভয় দেখাল। এখনো তো আমার জীবন হুমকির মুখেই আছে। কিন্তু আমি ওগুলো এখন আর ভয় পাই না। আমি আবার সেই সাংবাদিকতা পেশাতেই ফিরব।’
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: