সোমবার, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৭ই আশ্বিন ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


সংক্রামক রোগের বিস্তার : সচেতনতা ও প্রতিরোধ ছাড়া মুক্তি নেই


প্রকাশিত:
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১:৩৪

আপডেট:
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:২৬

ছবি : সংগৃহীত

আমাদের দেশের ফার্মেসিগুলো কেবল ওষুধ কেনাবেচার স্থান নয়, এটি মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে অধিকাংশ ফার্মেসি শুধু ব্যবসার দিকেই মনোযোগ দেয়। তারা সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ কম নেয়, ফলে সাধারণ মানুষ সঠিকভাবে ওষুধ ব্যবহারের নিয়ম জানে না এবং অনেক সময় নিজেরাই ভুলভাবে ওষুধ সেবন করে জটিল স্বাস্থ্যসমস্যার ঝুঁকিতে পড়ে।

ফার্মেসিগুলো চাইলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তারা গ্রাহকদের সঠিকভাবে ওষুধ ব্যবহারের নিয়ম শেখাতে পারে যেমন অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া বা টিকা সংক্রান্ত তথ্য প্রচার করা। সংক্রামক রোগ নিয়ে রোগীদের সচেতন করার জন্য দোকানে পোস্টার, লিফলেট ও ব্যানারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য-টিপস প্রদান করাও একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

সংক্রামক রোগের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ১৮৪৯ সালে একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক প্রথম কলেরাকে একটি সংক্রামক রোগ হিসেবে প্রস্তাব করেন। তার গবেষণাকে আধুনিক মহামারি বিদ্যার সূচনা বলা হয়। ইতিহাসে বহুবার সংক্রামক রোগ মহামারির রূপ নিয়ে মানব সমাজে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। মধ্যযুগীয় ইউরোপের প্লেগ, ঊনবিংশ শতাব্দীর কলেরা মহামারি, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। সংক্রামক রোগের সংখ্যা এবং বৈচিত্র্য অনেক। এদের মূলত চারটি বড় দলে ভাগ করা যায়—

ভাইরাসজনিত রোগ: যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, জলবসন্ত, কোভিড-১৯ ইত্যাদি,

ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ: যেমন কলেরা, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, প্লেগ ইত্যাদি,

পরজীবীঘটিত রোগ: যেমন ম্যালেরিয়া, আমাশয়, ফাইলেরিয়াসিস ইত্যাদি,

ফাঙ্গাসজনিত রোগ: যেমন রিংওয়ার্ম, ক্যান্ডিডিয়াসিস ইত্যাদি।

প্রতিটি শ্রেণির সংক্রমণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় এদের সঠিক সনাক্তকরণ ও নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংক্রামক রোগের বিস্তার নানাভাবে ঘটতে পারে যেমন,

বায়ুবাহিত সংক্রমণ: কাশি, হাঁচি বা কথা বলার মাধ্যমে জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্যের শরীরে প্রবেশ করে।

খাদ্য ও পানীয় দ্বারা: দূষিত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করলে রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করে।

সরাসরি সংস্পর্শে: সংক্রামিত ব্যক্তির শরীর, ক্ষত বা ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংস্পর্শে এলে রোগ ছড়াতে পারে।

পোকামাকড় বা বাহক দ্বারা: বিশেষত মশা, মাছি বা অন্যান্য বাহকের মাধ্যমে রোগ এক ব্যক্তি থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকা শহরসহ দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চলে বর্তমানে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা মারাত্মক চাপে পড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে জুলাই মাসে, যেখানে ৪১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে মাসে ৩ জন, জুনে ১৯ জন, আগস্টে ৩৯ জন এবং ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও ১৫ জন মারা গেছেন। এ বছর এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৪ জনে। এত বিপুল সংখ্যক রোগী সামাল দিতে হাসপাতালগুলোর অতিরিক্ত বেড যোগ করতে হচ্ছে এবং চিকিৎসক-নার্সদের ওপরও অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, যদি মশা নিয়ন্ত্রণ অভিযান কার্যকরভাবে পরিচালনা না করা হয়, তবে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কীটতত্ত্ববিদ বলেন, এডিস মশা শহুরে জীবনে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, “নির্মাণস্থল, বাসার ছাদে জমে থাকা পানি, এমনকি ফুলের টবও এখন এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এসব স্থান নিয়মিত ধ্বংস না করলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব আগামী বছরগুলোয় আরও বড় আকার ধারণ করবে।”

অন্যদিকে চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে চিকুনগুনিয়ার পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে গড়ে ৭০ থেকে ৭১ শতাংশ রোগীর শরীরে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। এই পরিসংখ্যান পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও রোগের দ্রুত বিস্তারের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।

চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে। এপিক হেলথ কেয়ারে ১৮৫ জন রোগীর মধ্যে ১৫৩ জন (প্রায় ৮২ শতাংশ) চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে ১৩২ জনের মধ্যে ৬৫ জন (প্রায় ৪৯ শতাংশ) এবং পার্কভিউ হাসপাতালে ৫৩ জনের মধ্যে ৪২ জনের (প্রায় ৭৯ শতাংশ) শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, চট্টগ্রামে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় প্রতিটি রোগীই কার্যত চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সরকারি পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা না থাকায় প্রকৃত সংক্রমণের মাত্রা ও বিস্তৃতি নিরূপণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে সময়মতো পরীক্ষা ও রোগনির্ণয় না হলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণত হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর দেখা দেয় এবং এর সঙ্গে থাকে তীব্র অস্থি ও সন্ধি ব্যথা, যা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, শরীরে রাশ, চোখে জ্বালা, বমি বমি ভাব ও দুর্বলতা অন্যতম। অনেক সময় রোগীর হাত-পা ফুলে যায়, বিশেষ করে বৃদ্ধাঙ্গুলির সন্ধিতে ব্যথা তীব্র আকার ধারণ করে। যেহেতু এখনো চিকুনগুনিয়ার কোনো ভ্যাকসিন বা নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই, তাই সঠিক রোগ শনাক্তকরণ ও সময়মতো চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় এটি নীরবে মহামারির রূপ নিতে পারে।

চট্টগ্রাম বর্তমানে কীটতত্ত্বগত দিক থেকেও উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, নগরীর অনেক ওয়ার্ডে এডিস মশার প্রজনন হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্টারিয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশনের গবেষণা অনুযায়ী, এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের ইনডেক্স (Breteau Index বা BI) ২৫ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭৫ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যেখানে ২০-এর ওপরে মানেই সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হবে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা ও ব্যক্তিগত সচেতনতা বাড়ানো। ঘরবাড়ি ও আশপাশে জমে থাকা পানি নিয়মিত ফেলে দেওয়া, ফুলদানি, ড্রাম, টায়ার বা এয়ার কুলারের পানি পরিষ্কার করা, সিটি কর্পোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণ অভিযান জোরদার করা এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য দিনেরবেলায়ও মশারি ব্যবহার বা মশারোধক ক্রিম প্রয়োগ করা জরুরি। পাশাপাশি, সরকারি পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণ ও দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। চিকুনগুনিয়া এখন আর সাধারণ জ্বর নয় বরং চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য শহরের জন্য এটি একটি বড় জনস্বাস্থ্য সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সরকারি উদ্যোগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই কেবল এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরেই সচেতনতা জরুরি। নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, নিরাপদ পানি পান করা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, টিকা গ্রহণ, মশারি ব্যবহার এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একইসঙ্গে সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে নিয়মিত সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি এবং মহামারি পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সংক্রামক রোগ মানব সমাজের জন্য দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও টিকার উন্নতির ফলে অনেক সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবুও নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সতর্কতা ও সচেতনতা সবসময় বজায় রাখা জরুরি। ব্যক্তি ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সংক্রামক রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার : মেম্বার সেক্রেটারি, বাংলাদেশ নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ফোরাম; প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top