বুধবার, ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৬শে ভাদ্র ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


তাপমাত্রা কমাতে গাছ যেভাবে ভূমিকা রাখে


প্রকাশিত:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১:৫৩

আপডেট:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৫:০৫

ছবি : সংগৃহীত

গাছ প্রকৃতির মহামূল্যবান দান। গাছ শুধু সৌন্দর্য ছড়ায় না, মানুষের বেঁচে থাকার শ্বাসপ্রশ্বাসকেও নিরাপদ করে তোলে। কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে আমাদের বায়ুমণ্ডল করে শুদ্ধ, পরিবেশ রাখে শীতল, আর প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতায় গাছ যেন পৃথিবীর প্রাকৃতিক শীতলকারক, যা নীরবে মানুষের জীবনকে করে তোলে আরামদায়ক। আবার আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টিপাত নামার পেছনেও আছে গাছের অদৃশ্য ভূমিকা। তাই গাছ কেবল প্রকৃতির অলংকার নয়, মানবজীবনের রক্ষকও বটে। সুতরাং গাছ লাগানো ও লালন করা মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক নিরাপদ, শীতল ও সবুজ পৃথিবী নির্মাণ করা।

কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ:

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) এর মাত্রা বৃদ্ধি। কার্বন ডাই-অক্সাইড একটি গ্রিনহাউস গ্যাস, যা সূর্যের তাপ ধরে রাখে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেখা দেয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং, আবহাওয়ার অস্থিরতা এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

এই সমস্যার কার্যকর সমাধানে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। একটি মাত্র ১৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের গাছ বছরে প্রায় ২২ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম। গাছ তাদের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া তথা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বাতাস থেকে CO₂ গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন নির্গত করে।

ফলে বাতাসের দূষণ কমে, পরিবেশে শীতলতা বৃদ্ধি পায় এবং স্থানীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। যদি বৃহৎ আকারে বৃক্ষরোপণ করা হয়, তবে লাখো টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাস থেকে শোষিত হবে। এর ফলে শুধু পরিবেশই শীতল হবে না, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মাটির ক্ষয় রোধ ও সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলাও সম্ভব হবে।

তাই প্রত্যেকের উচিত নিয়মিত গাছ লাগানো এবং লাগানো গাছের যত্ন নেওয়া। অতএব বলা যায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে গাছ কেবল তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেই নয়, পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতেও সরাসরি ভূমিকা রাখে।

পরিবেশ ঠান্ডা রাখা:

একটি বয়স্ক গাছ শুধু অক্সিজেন প্রদানই করে না, বরং পরিবেশকে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিণত গাছ দিনে প্রায় ৩৭৯ লিটার পানি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বাতাসে ছাড়ে। এই প্রক্রিয়াকে ট্রান্সপিরেশন বলা হয়।

গাছ যখন মাটির পানি শোষণ করে, তখন তা পাতার মাধ্যমে বাতাসে জলীয়বাষ্প হিসেবে নির্গত হয়। এর ফলে আশপাশের তাপমাত্রা কমে আসে এবং পরিবেশ অনেকটা শীতল থাকে। শহরে যেখানে কংক্রিট ও যানবাহনের কারণে তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, সেখানে গাছই প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশনারের মতো কাজ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ তার আশেপাশের পরিবেশকে এমনভাবে ঠান্ডা রাখে, যা প্রায় ১০টি এয়ার কন্ডিশনারের সমপরিমাণ কাজের সমান। এতে বিদ্যুৎ খরচ নেই। এটি পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী সমাধান। গাছপালা শুধু মানুষকেই নয়, অন্যান্য প্রাণী ও পাখিদেরও ঠান্ডা আশ্রয় প্রদান করে। এছাড়া বয়স্ক বৃক্ষের ছায়া শহরের রাস্তাঘাট ও ভবনের তাপমাত্রা কমিয়ে শক্তির ব্যবহার হ্রাস করে।

যেসব স্থানে গাছ নেই, সেসব জায়গা গরমে বেশি উত্তপ্ত হয়, যা ‘হিট আইল্যান্ড এফেক্ট’ নামে পরিচিত। তাই পরিবেশ ঠান্ডা রাখতে বৃক্ষরোপণ ও পুরোনো গাছ সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। গাছ কেটে ফেলা নয় বরং রক্ষা করাই টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ:

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গাছের ভূমিকা সত্যিই বিস্ময়কর। গাছ দিনের বেলায় পাতার মাধ্যমে পানি নির্গত করে, যাকে বলা হয় বাষ্পীভবন (Transpiration)। এই প্রক্রিয়ায় বাতাসের আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়। ফলে চারপাশের পরিবেশ ঠান্ডা, আরামদায়ক ও বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

শহরে আমরা যেভাবে ইট, পাথর ও কংক্রিট ব্যবহার করি, তাতে ‘হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ তৈরি হয়। এর ফলে শহরের তাপমাত্রা আশেপাশের গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে যায়। কিন্তু যেখানে পর্যাপ্ত গাছ রয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকে। তাই নগর পরিকল্পনায় ছায়াদার ও বড় গাছ লাগানো অত্যন্ত জরুরি।

শুধু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নয়, গাছ পরিবেশের ধুলাবালি ও বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে, অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি বড় গাছ যদি ১০টি এসির সমান কাজ করতে পারে, তবে আমাদের উচিত এয়ার কন্ডিশনারের উপর নির্ভর না করে গাছ লাগানো ও রক্ষা করা। এতে বিদ্যুতের ব্যবহার কমবে, পরিবেশ বাঁচবে এবং মানুষ সুস্থ-স্বস্তিতে থাকতে পারবে। গাছই প্রকৃতির সেরা প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার।

সামগ্রিক তাপমাত্রা হাস:

শহরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও অবকাঠামো বৃদ্ধির ফলে তাপমাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কংক্রিটের ভবন, যানবাহনের ধোঁয়া এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ শহরের পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে তুলছে। এ অবস্থায় পরিকল্পিত বৃক্ষায়ন একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

গবেষণা বলছে, পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হলে শহরের সামগ্রিক তাপমাত্রা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো সম্ভব। গাছের ছায়া সূর্যের তাপ শোষণ কমায় এবং পরিবেশে ঠান্ডা ভাব সৃষ্টি করে। পাশাপাশি গাছ বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বাতাসে আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শহরের রাস্তার পাশে, পার্কে, খালি জমিতে এবং বাড়িঘরের চারপাশে গাছ লাগানো হলে শুধু পরিবেশই শীতল হয় না বরং বায়ু দূষণও অনেকটা কমে যায়। এছাড়া গাছ শহরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এবং মানুষকে মানসিক স্বস্তি দেয়।

পরিকল্পিত বৃক্ষায়ন নগরবাসীর জন্য সুস্থ পরিবেশ, শীতল বাতাস ও আরামদায়ক আবাসস্থল তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৃক্ষায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সব মিলিয়ে, সঠিক পরিকল্পনায় বৃক্ষরোপণ করলে নগর জীবনে গরমের দাপট অনেকটা হ্রাস পাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই একটি পরিবেশ নিশ্চিত হবে।

বৃষ্টিপাতে সহায়তা:

গাছ শুধু ছায়া দেয় বা অক্সিজেন তৈরি করে তাই নয়, বরং প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টিপাত ঘটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে গড়ে প্রায় ২০০০ লিটার বৃষ্টিপাত ঘটাতে সহায়তা করে। গাছের পাতার মাধ্যমে সূক্ষ্ম জলকণার বাষ্পীভবন (transpiration) হয় এবং তা বাতাসে আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে।

এই আর্দ্রতা মেঘ তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ঘটায়। অর্থাৎ একটি গাছকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পরিবেশে ক্ষুদ্র জলচক্র তৈরি হয়, যা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে যখন বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং আর্দ্রতা কমছে, তখন গাছই পারে সেই ঘাটতি পূরণ করতে।

শহরের আশপাশে যত বেশি গাছ থাকবে, তত বেশি আর্দ্রতা তৈরি হবে এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও বাড়বে। কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখা এবং শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশকে আর্দ্র রাখার জন্য এই বৃষ্টিপাত অত্যন্ত জরুরি। তাই বৃক্ষনিধন কমিয়ে পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ বাড়াতে হবে। প্রকৃত অর্থেই গাছ হলো প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ, যা জীবন ও পরিবেশের স্থিতিশীলতায় অপরিহার্য।

গাছ শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেই নয় বরং আমাদের পরিবেশ ও জীবনের জন্য অপরিহার্য সহায়ক। তারা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমণ্ডলকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিবেশকে শীতল রাখে। একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সহায়তা করে কৃষি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে গাছ লাগানো ও সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

সমীরণ বিশ্বাস : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top