আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ : প্রমিত বাংলা প্রসঙ্গ
প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২৫ ১০:৫২
আপডেট:
৩০ জুন ২০২৫ ১১:১৭

‘যদ্যপি আমার গুরু’ নামে প্রচারিত, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্লাসিক হয়ে ওঠা, আহমদ ছফার রাজ্জাকনামায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে দেখি নির্জলা ঢাকাইয়া বুলিতে কথাবার্তা বলছেন। এই এক আজব ব্যাপার। যেকোনো বিচারে অধ্যাপক রাজ্জাক বাংলাদেশের অভিজাত ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষ।
এই কোটার লোকজন বিশুদ্ধ কলকাতাই প্রমিতে কথাবার্তা বলাকে সংস্কৃতিবান হওয়ার পূর্বশর্ত গণ্য করে। অথচ রাজ্জাক সাহেব দেখছি কোনো চাপ না নিয়ে দিব্যি ঢাকাইয়্যা চালাচ্ছেন। তাও ‘কেমন আছি, কী করছি’ টাইপের কথাবার্তা হলে এক কথা। তার কথাবার্তার সীমানা কলা ও সমাজবিদ্যার আকাশ-পাতাল। দুনিয়ার বিকশিত এলাকাগুলোয় জ্ঞান নামে যা কিছু প্রকাশিত, অধ্যাপক রাজ্জাককে তার নিচে নামতে দেখি না। সবটাই দেখি তিনি অপ্রমিতে সামলে ফেলছেন। আহমদ ছফা পর্যন্ত এই ব্যাপারে কৈফিয়ত না দিয়ে পারেননি।
একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে। দ্বিতীয়ত ঢাকাইয়া বুলি তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন, তার মুখে শুনলে এই ভাষাটি ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়। তৃতীয়ত আমাকে তিনি মৌলবি আহমদ ছফা বললেন কেনো? আদর করে বললেন, নাকি অবজ্ঞা করলেন?’
দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে—এই কথার সাদা অর্থের বাইরেও সরল মর্মার্থ আঁচ করা কঠিন নয়। পুরো বইতে অধ্যাপক রাজ্জাকের যে-অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় আছে, তা যদি চর্মচক্ষুর তীক্ষ্ণতায় ধরা দিয়ে থাকে, বিস্ময়ের কারণ নেই। তদুপরি যারা আহমদ ছফার রূপকপ্রীতির সাথে পরিচিত, তাদের কাছে এই ধরনের কিছু একটা প্রথমে পাঠেই ধরা পড়ার কথা। ‘মৌলবি’ সম্বোধন নিয়ে আমরা পরে আলাপ করব। আপাতত ‘ঢাকাইয়া বুলি’র কাছে ফেরা যাক।
ছফা বলছেন, অধ্যাপক রাজ্জাক ঢাকাইয়া বুলি ব্যবহার করেন ‘অবলীলায়’। শব্দটা ছফা যে অর্থেই ব্যবহার করুন না কেন, তার প্রস্তাবিত চরিত্রটির ক্ষেত্রে এর গভীর তাৎপর্য আছে। কয়েক দশক ধরে ঢাকার সংস্কৃতিবান ভদ্রসমাজের একরোখা প্রমিতপ্রীতির বিপরীতে, নানা ধরনের অপ্রমিতের বাড়বাড়ন্ত আমরা দেখেছি। লেখায় বা বলায় প্রমিতের বাইরের কোনো কোনো রূপ নির্মাণের বিভিন্ন কৌশলও লক্ষ করেছি।
বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রশ্নে অধ্যাপক রাজ্জাকের গভীর সচেতনতার প্রেক্ষাপটে তার মুখের বুলিকে সেই ধরনের কোনো আয়োজন হিসেবে পড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আর সব ব্যাপারে যেমন, তেমনি ভাষা প্রশ্নেও একটা মত-মর্জিতে খুঁটি গেঁড়ে বৃত্ত রচনার ব্যাপারটা রাজ্জাক সাহেবের ধাতের সাথে যায় না। কাজেই এটা বলার অবকাশ সামান্যই থাকে যে, তিনি তার স্বভাবের বাইরে গিয়ে ভাষা বিপ্লবের অংশ হিসেবে ঢাকাইয়া বুলি জারি রেখেছেন। কথাটা অন্তত এক জায়গায় ছফা প্রশ্ন আকারে তুলেছেন—
আমার [ছফার] দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনে কোনোদিন বদরুদ্দীন উমরের বউয়ের বাংলা উচ্চারণ শুনছেন নিহি?
আমি বললাম, না, আমি শুনিনি।
এক্কেরে বিশুদ্ধ বাংলা কয়, উচ্চারণ নিখুঁত। আপনেগো উচিত তার বাংলা পাঠ ক্যাসেট কইরা রাখা। পরে খুব কামে আইব।
আমি বললাম, আপনি ত স্যার ঢাকার বাংলা বলেন, আমাদেরকে কেনো পশ্চিম বাংলার উচ্চারণরীতিটা অনুসরণ করতে বলছেন?
স্যার কথাটা পাশ কাটিয়ে গেলেন।
আসলে পাশ কাটিয়ে যাননি। ভিন্নভাবে যা বলেছেন, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত বলা যাক, ছফার আবদুর রাজ্জাক সম্ভাব্য কোনো ভোজেই আপত্তি করেন না। সারা দুনিয়াই তার সম্পদ। কলকাতায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে উপাদেয় ভোজ জমা হয়েছে অনেক দশকের চর্চায়, তাতে বিরাগের কোনো চিহ্ন তার মধ্যে, অন্তত ছফা-প্রস্তাবিত রূপে, দেখা যায়নি।
প্রথমবার দেখা হওয়ার পরে অধ্যাপক রাজ্জাক সম্পর্কে তার ধারণা কী হয়েছিল, সেই ঘটনা সংক্ষেপে টানতে গিয়ে আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘...তিনটে জিনিস আমার মনে দাগ কেটে বসে গিয়েছে। প্রথমত তার চোখের দৃষ্টি অসাধারণ রকম তীক্ষ্ণ....
তিনি শুধু ‘নিজে’র মুখটা ভুলতে চান না। সাথে মেজবানের মুখটাও মনে রাখতে চান। আর যে পটভূমিতে মেহমান ও মেজবান আছে বা ছিল, সেই পটভূমি থেকে ভোজটাকে আলগা করে ফেলেন না। এই জায়গায় সৈয়দ মুজতবা আলী তার একজন কাছের মানুষ হতে পারেন। বোঝাবুঝির স্বার্থে। যাই হোক, কলকাতাই প্রমিতে তার আপত্তি সেই কারণেই কোনো অ্যাসেন্সিয়াল কিছু নয়।
যারা উত্তরাধিকারসূত্রে বা সাংস্কৃতিকভাবে সেই ভাষা আত্মস্থ করতে পেরেছে, তাদের প্রতিও তার একবিন্দু বিরাগ নেই। আবার এও তিনি মনে করেন না, ভদ্রলোক সাজার মরিয়া চেষ্টায় সেই ভাষা নিজের জিবে-গলায় তুলে নিতেই হবে। নিজের ঢাকাইয়া বুলিটা তিনি নিশ্চয়ই বেড়ে ওঠার বিশেষ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেরণায় নিজেই আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু তাকেই অন্যের জন্য কর্তব্য আকারে পেশ করেননি। এই কারণেই বলেছি, অধ্যাপক রাজ্জাকের ক্ষেত্রে ‘অবলীলা’ কথাটার একটা প্রসারিত অর্থ আছে।
আহমদ ছফা অবশ্য আরও আগে বেড়েছেন। বলেছেন, রাজ্জাক সাহেবের মুখে ঢাকাইয়া বুলিটা ‘ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়’। কথাটা প্রাথমিকভাবে খানিকটা আপত্তিকর। সেই দিকটা পাত্তা না দিয়ে পড়লে কথাটার মানে দাঁড়ায়, আমাদের চেনাজানা ভদ্রলোকদের বুলিতে কথা না বললেও রাজ্জাক সাহেবকে নিছক ভাষাভঙ্গির কারণে ভদ্রশ্রেণির কোঠায় ফেলতে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু কথাটার আরও অন্তত দুটি অর্থ করা যায়, আধুনিক বাংলা ভাষার ব্যবহারিক ইতিহাসের দিক থেকে যেগুলোর প্রায়োগিক মূল্য অসামান্য।
প্রথমত, ভদ্রলোকের ভাষা স্রেফ ভাষা হিসেবে আলাদা কোনো গুণ বহন করে না; বরং ভদ্রলোকদের মুখে ভাষা ঠাঁই পাওয়াই তার চেকনাই ও জেল্লার উৎস। অর্থাৎ আবদুর রাজ্জাকদের মতো ভদ্রলোকরা কথা বললেই কেবল ঢাকাইয়া বুলি ভদ্রলোকদের ভাষা হয়ে উঠবার পারে।
দ্বিতীয়ত, ভাষায় আপনি কী বলছেন, তার ওপরই আসলে ব্যবহৃত ভাষার ওজন নির্ধারিত হবে। রাজ্জাক সাহেব যা বলতেন, তাতে তার বুলি ওজনদার না হয়ে পারেই না।
প্রত্যক্ষভাবে ছফা যা উচ্চারণ করেছেন, তার বাইরেও ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে ঢাকাইয়া বুলির অন্য বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। এই ভাষা বইটার শুধু চরিত্রায়ণের অংশ নয়, আবহেরও অচ্ছেদ্য অঙ্গ। একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা আবার বলা যাক।
তপন রায়চৌধুরীর আত্মজৈবনিক রচনা রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চার পাঠকরা ‘বাঙাল’ ভাষার কুশলী ব্যবহার এবং হাস্যরস সৃষ্টির মুনশিয়ানার দারুণ প্রশংসা করেছিলেন। প্রশংসাটা যোগ্য পাত্রেই পড়েছে। এই ভাষার ব্যবহার তার সুখ্যাত বাঙালনামায়ও যথেষ্ট আছে। একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে, শেষোক্ত বইয়ের ‘বাঙাল’ ভাষা তপন রায়ের আত্মতার অংশ নয়। ভাষাভঙ্গিটি তিনি তার যাপিত জীবনের সহচরদের সাথে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে কখনোই ব্যবহার করেননি, কেবল মনে মনে বলা কথাগুলোই এই ভাষায় ফেঁদেছেন।
বাঙালনামায় ‘বাঙাল’ ভাষা তার সৃষ্টিশীল রসাবেশ ও বৈচিত্র্য তৈরির অলঙ্কারবিশেষ। সাহিত্যিক গুণের দিক থেকে কলাটা দুর্দান্ত হয়েছে; কিন্তু আত্মতার বাহন হয়নি। পরিমাণে আরও বেশি হলেও রোমন্থনের ‘বাঙাল’ ভাষা বিষয়েও একই কথা খাটে। ছফা-প্রণীত আবদুর রাজ্জাকের বিষয়টা ঠিক বিপরীত। সেইখানে আলঙ্কারিক অভিলাষ নেই, স্বাতন্ত্র্য তৈরির বাসনা নেই, বড়কে চ্যালেঞ্জ করা বা ছোটকে বড় করে তোলার কৌশল নেই; অথচ চেষ্টা-তদবির ছাড়া একেবারেই পারিপার্শ্বিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে তার বুলি বড় ঘটনা হয়ে হাজির হয়েছে।
এতকিছু সত্ত্বেও, অথবা এসব কিছু সহই, আমরা রাজ্জাক সাহেবের ঢাকাইয়া বুলিকে তার আর-আর বিশিষ্টতার একটা হিসেবে পড়তে পারতাম। এই লোক চাকরির উন্নতির জন্যও কলম ধরে না, বিয়ে-থা না করেও দিব্যি সংসার করে, ব্যাখ্যা করা যায় না এমন সব কারণে গুরুতর লোকদের গুরুত্ব পায়, অথচ তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য ভদ্রগোছের এক সেট জামাকাপড় সংগ্রহে রাখে না। ইত্যাদি।
দশের মধ্যে এগারতম হিসেবে তার ঢাকাইয়া বুলিকে আমরা অনায়াসেই এই তালিকায় ফেলে দিতে পারতাম। বাধ সেধেছে আহমদ ছফার বয়ানে বাংলা ভাষা বিষয়ে তার এমনকিছু কথাবার্তা, অন্য অনেকে জনমভর সাধনা করে যেগুলো আবিষ্কার করেছে, অথবা আদৌ বুঝে না-উঠেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কথাটা বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখবার সুযোগ আছে। সেই কারণেই প্রমাণ দাখিলের স্বার্থে লম্বা উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
তিনি একজন সাহেবের নাম উচ্চারণ করলেন, ...সেই সাহেব নাকি একশ বছর আগে লিখে গিয়েছেন, বেঙ্গলে ঢাকা জেলার মানুষেরা বিশুদ্ধ বাংলায় কথাবার্তা কয়। ...বাংলা ভাষার মধ্যে যে পরিমাণ এলিট (elite) মাস (mass) গ্যাপ এই রকম দুনিয়ার অন্য কোনো ভাষার মধ্যে খুঁইজ্যা পাইবেন কি না সন্দেহ। আধুনিক বাংলা ভাষাটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা সংস্কৃত অভিধান দেইখ্যা বানাইছে। আসল বাংলা ভাষা এইরকম আছিল না।
আরবি ফারসি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষার লগে মিশ্যা ভাষার একটা স্ট্রাকচার খাড়া অইছিল। পলাশীর যুদ্ধের সময়ের কবি ভারতচন্দ্রের রচনায় তার অনেক নমুনা পাওয়া যাইব। ব্রিটিশ শাসন চালু অইবার পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা আরবি ফারসি শব্দ ঝাঁটাইয়া বিদায় কইর্যা হেই জায়গায় সংস্কৃত শব্দ ভইর্যা থুইছে। বাংলা ভাষার চেহারা কেমন আছিল, পুরানা দলিলপত্র খুঁইজ্যা দেখলে কিছু প্রমাণ পাইবেন।
আমি বললাম, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা যে গদ্যরীতিটা চালু করেছিলেন, সেটা তো স্থায়ী হতে পারেনি। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এসে বাংলা গদ্যের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এবং রূপান্তর ঘটে গেছে।
পরিবর্তন ত অইছে। কিন্তু কীভাবে অইছে এইটা দেখন দরকার।
আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে পরিবর্তনটা হয়েছে। স্যার বললেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা ভাষার স্ট্রাকচারটা খাড়া করেছিলেন, তার লগে ভাগীরথী পাড়ের ভাষার মিশ্রণে আধুনিক বাংলা ভাষাটা জন্মাইছে। আধুনিক বাংলা বঙ্গসন্তানের ঠিক মুখের ভাষা না, লেখাপড়া শিখ্যা লায়েক অইলে তখনই অই ভাষাটা তার মুখে আসে।
খুব জরুরি নয়, তবু ধরে নিচ্ছি, উপরের কথাগুলোর মূল কাঠামো রাজ্জাক সাহেবেরই বলা। ছফার নিজের চিন্তায় এই দিকগুলোর প্রাধান্য থাকলে তার অন্য লেখালেখিতে উল্লেখ পাওয়া যেত।
প্রথম বাক্যের ‘বিশুদ্ধ বাংলা’ কথাটা খুব সুবিধা হয়নি। সেই দিকটা বাদ দিলে আদতে কথাটা বিধ্বংসী। পুরোনো শহর হিসেবে এবং বিশিষ্ট শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার ভাষার যে-একটা ‘জুতসই’ ভদ্রলোকি কৌশল বিকশিত হয়েছিল, হতে বাধ্য, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তার মানে অবশ্য এই নয়, ওই বিলুপ্ত ভাষারীতি পুনরুদ্ধারের আয়োজনে এখন সদলবল নেমে পড়তে হবে। কিন্তু এই অনুসন্ধানের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বুঝে ওঠার মতো মেরুদণ্ড নতুন ঢাকার নাগরিকরা এখনো পেয়ে ওঠেনি। রাজ্জাক সাহেবের আন্দাজের মধ্যে, দেখতে পাই, হিসেবটা পাকাপোক্তভাবেই ছিল। এর পরের কথাগুলো, আহমদ ছফার শব্দ ধার করে বলা যায়, এক-একটা মণিমুক্তা। পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার একটা উত্তুঙ্গ সম্মিলনে মানুষ জটিল বিষয়গুলো হাতের তালুতে রেখে দেখার মতো করে দেখতে পারে। এর প্রতিটি সেই মাত্রার সিদ্ধান্ত।
বাংলা ভাষায় ‘এলিট-মাস গ্যাপ’ দুনিয়ার চেনা অভিজ্ঞতার মধ্যে সর্বোচ্চ, এই কথাটা পরিষ্কারভাবে বলেছেন শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৮৭৭ সালে, আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাচরণেরই সমর্থন হিসেবে, ১৮৭৮ সালে। প্রফেসর রাজ্জাক-যে শোনা কথা চালাননি, তার প্রমাণ পাই পরের বাক্যগুলোয়। দুইটা কথা আছে সেইখানে।
প্রথমত, আঠার শতকে বাংলার একটা আলাদা কাঠামো ছিল, ভারতচন্দ্রের লেখায় যার উদাহরণ মেলে, আর পাওয়া যায় প্রায় যেকোনো পুরোনো দলিল-দস্তাবেজে। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা সংস্কৃত অভিধান ঘেঁটে নতুন ভাষা আবিষ্কার করেছেন। তার মানে নতুন ভাষায় মুখের ভাষার আদলটা রক্ষিত হয়নি। ভাষা এসেছে ‘কলম থেকে মুখে’, যে কথাটা অন্য অনেকের মধ্যে প্রমথ চৌধুরীও প্রচার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, পণ্ডিতেরা ‘আরবি ফারসি শব্দ ঝাঁটাইয়া বিদায় কইর্যা হেই জায়গায় সংস্কৃত শব্দ ভইর্যা থুইছে’। কয়েক দশকে হাজার হাজার পৃষ্ঠার গবেষণা থেকে এই বিষয়ে আমাদের যে-জ্ঞান হয়েছে, তার ওপর ভর করে নিশ্চিন্তে বলা যায়, ‘ঝাঁটাইয়া বিদায় করা’ এবং ‘ভইর্যা থোয়া’—এই দুই প্রকাশভঙ্গির বাইরে অন্য কিছু এই অবস্থাকে এতটা জুতমতো প্রকাশ করতে পারত না।
রাজ্জাক সাহেবের বিবরণীতে ‘সাহেবপক্ষ’ বাদ পড়েছে। উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াটাও চাপা পড়ে গেছে। অবশ্য তিনি যা বলেছেন, তা উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াই বটে। এই পরিভাষা তখনো চালু হয়নি।
এরপরের কথাটা, এই বিষয়ক প্রায় তাবৎ লেখালেখির সাথে পরিচয়ের সুবাদে বলতে পারি, কোথাও বিশ্লেষিত হয়নি। এমনকি আসলে এত নিখুঁতভাবে উত্থাপিতও হয়নি। উনিশ শতকের দানবাকৃতির সংস্কৃতায়নের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের ভদ্রলোকসমাজ প্রায় একযোগে বলে ওঠেন, পুরোনো বাংলায়ও সংস্কৃতায়ন হয়েছে, আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলাচর্চার দোষ বঙ্কিম পর্যন্ত আসতে আসতেই কেটে গেছে।
এই কথাগুলো এত উপরিতলের যে, এগুলো ঠিক আলোচনার যোগ্যই নয়। কিন্তু উনিশ শতকের ভাষাচর্চার দোষ শনাক্ত করা খুব সহজও নয়। কারণ, ওই ভাষায় জগদ্বিখ্যাত সাহিত্য রচিত হয়েছে, আর ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে বিখ্যাত যাবতীয় চর্চার আধারও ওই ভাষাচর্চা। আবদুর রাজ্জাক দুই বাক্যে যে সমাধা করলেন, তা ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও বর্তমানকে এক পাত্রে সুচারুভাবে মিশিয়েছে।
চলিত বাংলাটা কৃষ্ণনগরীয় ভাষার ছাদে তৈরি—এই প্রচলিত প্রবাদকে পরিবর্তন না করেই তিনি প্রকৃত প্রক্রিয়াটা সামনে নিয়ে এলেন। আসলে কৃষ্ণনগরীয় ছাদ থেকে লেখার ছাদটা তৈরি হয়নি, বরং লেখার ভাষার সাথে নদীয়া মিশেছে। তার ফল হয়েছে মর্মান্তিক। ‘পড়াশোনা শিখে’ বড় হওয়ার পরেই কেবল ভাষাটা মুখের মাপে ধরা পড়ে, তার আগে নয়—এই উচ্চারণে বাংলা ভাষার উপনিবেশজনিত সংকটের, আমার জানা, সর্বোত্তম বিবরণটি আছে।
বলছিলাম, ছফা নিবেদিত আবদুর রাজ্জাকের ‘ঢাকাইয়া বুলি’ শুধু অন্তরঙ্গ নয়, আরও বহু-বিচিত্র মাত্রাযুক্ত। আমাদের পরবর্তী আলোচনা থেকে তার আরেক মাত্রার সন্ধান পাওয়া যাবে।
উপরে আধুনিক কালের বাংলাভাষা চর্চা সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাকের যে-গভীর প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া গেছে, তার নিরিখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, সচেতনভাবেই তিনি মুখের বুলি থেকে কলকাতাই প্রমিত পরিহার করেছেন। বস্তুত ঢাকার বাংলা চর্চাকারীদের যে-অংশ কলকাতাই প্রমিতে ধার্মিক, আর যে অংশ ওই প্রমিতের বিরোধিতা করাকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রধানতম কর্তব্য মনে করেন, উভয় দলের জন্যই এই সিদ্ধান্ত সুবিধাজনক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ‘যদ্যপি আমার গুরু’ পর্যাপ্ত উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছে, এই সূত্র দিয়ে রাজ্জাককে কায়দা করা যাবে না।
উনিশ শতকের কলকাতাই প্রমিতে উৎপাদিত মিঠাই-মণ্ডায় রাজ্জাকের মোটেই বিরাগ দেখা যায়নি। অনুবাদের জন্য তিনি একবার বাছাই করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই বাংলার ব্রত। কলকাতায় উনিশ শতক সম্পর্কে তার মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বাংলা ভাষার নানামুখী চর্চা।
রামমোহন রায়ের নামে প্রচারিত প্রায় যাবতীয় কৃতিত্ব পরিবর্তন করে তিনি বড় করে তুলেছেন তার বাংলা লেখা ও ব্যাকরণ রচনাকে। বলেছেন, তার গুণের তো অভাব ছিল না। অনেক ভাষা জানতেন। কিন্তু চর্চা করেছেন প্রধানত বাংলা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও মূল্যায়ন করেছেন একই ভিত্তিতে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাচর্চা, তার যেকোনো রূপে, অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে মূল্যবান।
এর গোঁড়ায় আছে তার খাঁটি বুর্জোয়া মন। রাজ্জাককে কিছুতেই ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী বলা যাবে না, বাংলাদেশ আন্দোলনে সর্বসমর্থন এবং সক্রিয়তা সত্ত্বেও। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চাকেই তিনি সার্বিক উন্নতির প্রথম শর্ত মনে করতেন। যে উৎসাহে তিনি বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাচর্চাকে গভীরভাবে অনুমোদন করেছেন, সেই একই ন্যায়ে মনোযোগী ছিলেন পূর্ব বাংলা ও বাঙালি মুসলমানের বাংলায়।
খেয়াল করেছেন, মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণ একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। মনে রেখেছেন, পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণের মতো বাঙালি মুসলমানের উচ্চারণভঙ্গি ও লব্জ আধুনিক ইতিহাসে ব্যাপক অপরায়ণের শিকার হয়েছে। জসীমউদ্দীনের উচ্চারণে ‘ছ’-এর ব্যবহার ও আহমদ ছফাকে বরাবর ‘মৌলবি’ সম্বোধন হয়তো সেই স্মৃতিকে জ্যান্ত রাখার এক ব্যক্তিগত উদ্যম। তার মানে আবার এই নয়, তিনি অন্যদেরও সেই উচ্চারণে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
যা গেছে, তা ফিরে আসে; কিন্তু কী রূপে এবং তাৎপর্যে ফিরে আসে, তা নির্ধারণ করাই বস্তুত ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ। ছফা যদি জিজ্ঞাসা করতেন, আপনি নিজে যা বলেন, তা অন্যদের বলতে উৎসাহিত করেন না কেন, আহমদ ছফার রাজ্জাক হয়তো মুখ বাঁকিয়ে বলতেন, ‘মারামারি করমু নিহি!’
ভাষার প্রশ্নে রাজ্জাকের এই অবস্থানই হলো খাঁটি লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি। বলতে পারি, আহমদ ছফা পূর্ববঙ্গ, বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশের জন্য এক লিবারেল আইকন খুঁজেছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে। বাংলা ভাষা প্রশ্নে চালু ও কম-চালু অনেকগুলো দিকের অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণও তার সেই তত্ত্বতালাশের অংশ।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম : মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
এসএন /সীমা
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: