শিক্ষা খাতে বাজেট, আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
প্রকাশিত:
২৯ জুন ২০২৫ ১০:৩২
আপডেট:
২৯ জুন ২০২৫ ১৬:২৫

০২ জুন ২০২৫ উত্থাপিত হলো বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট। যেখানে অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতের জন্যও বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
উত্থাপিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ। বর্তমান উপস্থাপিত বাজেট দেখা যায় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের চেয়ে টাকার অংকে ৯৩৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছর শিক্ষা খাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। খরচ করা ওই টাকার পরিমাণ ছিল সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশ।
অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষাখাতে টাকার অংকের হিসেবে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়লেও এই খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে অনেকটাই কমেছে। এই বাজেট নিয়ে নানা মহলে নানা ধরনের আলোচনা চলমান রয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের সরবরাহের জন্য পাঠ্যপুস্তকে বরাদ্দ ১ হাজার ৬২৬ কোটি রাখা, মাদ্রাসা শিক্ষায় এবতেদায়ী পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান এবং মাদ্রাসাগুলোর এমপিওভুক্তি বাবদ ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন।
এছাড়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় ধরেই বাজেট বরাদ্দে টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পেলেও যা খরচের খাত হিসেবে বেতন ভাতা প্রদান আর ভৌত অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ খাতেই বর্তমান কার্যক্রম চলমান রাখাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং আগামী অর্থ বছরেও এসব বিষয়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষায় প্রস্তাবিত বরাদ্দ টাকা হিসাবে কিছুটা কমলেও গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গুটিকয়েক বিষয়ে আশার বাণী দেখা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ততটা সমন্বয় ঘটেনি।
বিশ্বের সর্বত্রই শিক্ষা মানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে জিডিপির অনুপাতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমা যাওয়াটা দুঃখজনক। যে কোনো শুভ উদ্যোগের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ও নিয়ন্ত্রণকারী অন্যতম নিয়ামক হলো ফাইন্যান্স বা অর্থবরাদ্দ।
বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কীভাবে আশা করতে পারি? শিক্ষা খাতের বাজেটে টাকার অঙ্কে যতটুকু বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে ততটা আশানুরূপ নয়, আবার তার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কমে যাওয়া অনেকটাই হতাশার। অথচ বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আশা ছিল শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।
সরকারের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকায় শিক্ষায় আশানুরূপ বরাদ্দ হয়তোবা আসেনি। রাজস্ব আদায়ের হার আশানুরূপ থাকলে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত হয়তোবা আরও অগ্রাধিকার পেত বলে আমরা ধারণা করতে পারি। কিন্তু আমাদের ধারণায় কিছু আসে যায় না যখন প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি খাতার ব্যবধান যখন বেশি হয় তখনই হতাশা জেঁকে ধরে।
প্রতিটি জাতির উন্নতি, অগ্রগতির মান নির্ভর করে সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির মান দ্বারা। এজন্য বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সমুন্নত রাখতে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ ও সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য। যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়া।
বাংলাদেশের শিক্ষা খাত এখনো নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে—পর্যাপ্ত অবকাঠামো, মানসম্মত শিক্ষক, আধুনিক পাঠ্যপুস্তক, প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা, উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা বরাদ্দ ঘাটতি। আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে দেখা যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ এবং বাজেটের ১১.৬ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপির ১.৭ শতাংশ এবং বাজেটে ১১.৮৮ শতাংশ। এবারেও বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা উন্নয়ন অর্জনের জন্য শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি অপরিহার্য। আর শিক্ষায় বিনিয়োগ মানে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
বাজেট ঘোষণার পূর্বে আমাদের আশা ছিল এবারে উচ্চ শিক্ষার মানে নজর দেওয়া হবে, কারণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা পিছিয়ে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। আর তাই গবেষণা সুবিধা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন।
গবেষণার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারে। এছাড়াও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে—বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত গবেষণাগার। গবেষণা নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সৃষ্টির দরজা খুলে দেয়।
প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প এবং পরিবেশ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গবেষণা আমাদের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আবার অন্যদিকে কর্মসংস্থান তৈরি এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের জন্য টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং খাতে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হলেও এখানে বিনিয়োগ ঘাটতি আছে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উন্নয়নে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন দক্ষ শিক্ষকই পারেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করতে। এই বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে সরকার প্রতি বছর প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ দিয়ে থাকে কিন্তু সেটিও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এবারে প্রত্যাশা ছিল শিক্ষক প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকবে এবং সেটি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবায়নেও কার্যকর পদক্ষেপে নেওয়া হবে।
যাই হোক আমরা ভালো কিছুর প্রত্যাশা করি, আগামীর দিনগুলোয় বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টজনদের অনুরোধ করছি।
সেইসাথে শিক্ষাখাতে ইউনেস্কো ঘোষিত মানদণ্ড অনুযায়ী বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লক্ষ্য অর্জন, শিক্ষার মান উন্নয়ন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্প্রসারণ, গবেষণার সুযোগ বাড়ানো এবং দক্ষ, সমৃদ্ধ ও টেকসই জাতি গঠন সম্ভব। যা ভবিষ্যতে আমাদের প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল পৃথিবী তৈরি করবে।
সৈয়দ মো. সিয়াম : সহকারী অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: