আউশ ও আমন মৌসুমে কৃষকের বিকল্প কী?
প্রকাশিত:
২০ জুন ২০২৫ ১১:২৮
আপডেট:
২০ জুন ২০২৫ ১৭:৫৩

বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের তিনটি প্রধান মৌসুম রয়েছে—বোরো, আউশ ও আমন। প্রতিটি মৌসুমে ধানের চাষ ও কাটার নির্দিষ্ট সময়সীমা বা টাইমলাইন আছে। প্রতিটি ধানের মৌসুমের সময়কাল (Timeline) হলো—বোরো ধান মৌসুম: বপন/রোপণ সময়: নভেম্বর – জানুয়ারি। ফসল কাটা সময়: এপ্রিল – জুন। শুকনো মৌসুমে সেচ নির্ভর ধান। সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ধান এই মৌসুমে হয়।
আউশ ধান মৌসুম: বপন/রোপণ সময়: মার্চ – মে। ফসল কাটার সময়: জুলাই – আগস্ট। বর্ষার শুরুতে চাষ হয়, তুলনামূলক কম উৎপাদনশীল।
আমন ধান মৌসুম: বপন/রোপণ সময়: জুন – আগস্ট। ফসল কাটার সময়: অক্টোবর – ডিসেম্বর। বৃষ্টি নির্ভর প্রধান মৌসুম। প্রাকৃতিক পানিতে চাষ হয়।
বাংলাদেশে তিনটি প্রধান ধান উৎপাদনের মৌসুম বোরো, আউশ এবং আমন। এ তিন মৌসুম মিলেই দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতভাগের প্রায় পুরোটাই কভার করে। মৌসুমভিত্তিক ধান উৎপাদনের প্রায় গড় কভারেজ (শতকরা অংশ) হলো—বোরো ধান উৎপাদনের অংশ প্রায় ৫৫–৬০ শতাংশ। আমন ধান উৎপাদনের অংশ প্রায় ৩৫–৩৮ শতাংশ। আউশ ধান উৎপাদনের অংশ প্রায় ৭–১০ শতাংশ।
বিকল্প কী?
বর্তমানে আউশ ধান রোপণের শেষ সময় এবং আমন ধানের বীজতলা প্রস্তুতির উপযুক্ত সময়। এই সময় কৃষকরা ধান চাষের পাশাপাশি অন্যান্য কৃষি উৎপাদনেও গুরুত্ব দিয়ে আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন।
প্রথমত, সবজি চাষ—এই মৌসুমে পুঁইশাক, ধনে পাতা, লাল শাক, ডাটা শাক, লাউ, করলা, পটল, ঢেঁড়স ইত্যাদি চাষের উপযুক্ত সময়। ধানের সাথে আংশিক জমি এসব চাষে ব্যবহার করলে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত, মাছচাষ—বর্ষাকালীন জলাধার, পুকুর বা বৃষ্টির পানি জমা হওয়া জায়গাগুলোয় দেশি প্রজাতির মাছ যেমন ট্যাংরা, শিং, মাগুর ছাড়াও রুই, কাতলা ও তেলাপিয়া মাছ চাষ শুরু করা যেতে পারে। ধানের জমিতে ধান-মাছ সমন্বিত চাষও একটি লাভজনক ব্যবস্থা।
তৃতীয়ত, জৈবসার ও কম খরচে টেকসই চাষ—আউশ ও আমন ধানে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের সুষম প্রয়োগের পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহার করে জমির উর্বরতা ধরে রাখা উচিত। জলাবদ্ধতা রোধে নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
চতুর্থত, রোগবালাই ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ—পাতা পোড়া, ব্লাস্ট বা পাতা মোড়ানো পোকা দেখা দিলে অনুমোদিত জৈব-কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পঞ্চমত, খামার ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ—স্থানীয় কৃষি অফিস বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে প্রযুক্তি ভিত্তিক চাষাবাদ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি ও ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব। সবশেষে, এই সময়ের কার্যকর পরিকল্পনা ও বহুমুখী কৃষি উৎপাদন কৃষকের আয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কৃষি ও কৃষকের করণীয়:
দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, বাজারের প্রতিযোগিতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। তাই এই প্রেক্ষাপটে কৃষিতে স্থিতিশীলতা আনতে ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কিছু জরুরি করণীয় রয়েছে।
আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির গ্রহণ: বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির। কৃষকদের উচিত আধুনিক প্রযুক্তি যেমন কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি, স্মার্ট AI মোবাইল অ্যাপ, IoT, স্যাটেলাইট তথ্য, ড্রোন প্রযুক্তি, এবং অটোমেটেড যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখা ও প্রয়োগ করা। এতে যেমন উৎপাদন খরচ কমবে, তেমনি ফসলের গুণগতমান ও ফলনও বাড়বে।
জলবায়ু সহনশীল চাষাবাদ: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনির্দিষ্ট বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ ঘনঘন ঘটছে। কৃষকদের উচিত খরা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল ধানের জাত, সবজি ও অন্যান্য ফসল বেছে নেওয়া। যেমন বিআর২২, বিআর৫২ এবং স্বর্ণ ধান জাতসমূহ খরা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল।
বর্তমানে দেশে জলবায়ু পরিবর্তন ধকল সহনশীল বিভিন্ন জাতের সবজি ফল-ফসলেরও উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। কৃষকদের উচিত উন্নত জাতের সবজি, ফল-ফসল বেছে নেওয়া।
ফসল বৈচিত্র্য ও ঘূর্ণায়মান চাষ: একই জমিতে বারবার এক ফসল করলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই কৃষকদের উচিত মৌসুমি ও চাহিদাভিত্তিক ফসলের বৈচিত্র্য আনা এবং ফসল ঘূর্ণায়ন করা। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং রোগবালাই কমে।
জৈব ও টেকসই কৃষিপদ্ধতি: অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জৈব সার, ভার্মি কম্পোস্ট, বায়োফার্টিলাইজার এবং প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহারে কৃষি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই হবে।
বাজার ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ: কৃষকরা প্রায়ই মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। তাদের জন্য প্রয়োজন স্থানীয় কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্র, কৃষক বাজার এবং ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে প্রবেশাধিকার। সরকার এবং এনজিওদের সহযোগিতায় কৃষকদের সংগঠিতভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা করা জরুরি।
কৃষি প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: সচেতন ও শিক্ষিত কৃষকই আধুনিক কৃষির চালিকাশক্তি। কৃষি অফিস, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনজিওদের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা প্রযুক্তি ও বাজার উভয় দিকেই দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন।
কৃষি ঋণ ও বিমা ব্যবস্থার উন্নয়ন: ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে কৃষি ঋণ এবং ফসল বিমা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতির ক্ষতিপূরণ পেলে কৃষকরা হতাশ না হয়ে আবারও চাষে মনোযোগ দিতে পারবেন।
বর্তমানে কৃষি শুধুমাত্র জীবিকা নয় বরং টেকসই উন্নয়নের একটি মূল স্তম্ভ। কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে উৎসাহ দেওয়া এবং ন্যায্য বাজার নিশ্চিত করার মাধ্যমে কৃষি খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাই কৃষক ও কৃষিনীতির মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি সমৃদ্ধ ও নিরাপদ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, এটাই সময়ের দাবি।
সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: