শনিবার, ১৪ই জুন ২০২৫, ৩১শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

Shomoy News

Sopno


সংস্কৃতির দ্বার সর্বক্ষেত্রে উন্মুক্ত চাই


প্রকাশিত:
১৩ জুন ২০২৫ ১১:২৫

আপডেট:
১৪ জুন ২০২৫ ১৫:১১

ছবি সংগৃহীত

আমাদের জীবনে সংস্কৃতি না থাকলে তাতে কী আসে যায়! আমরা বেঁচে আছি, না মরে গেছি, সেটি এখন নিশ্চিত হতে পারছি না। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, নার্স নেই, এমনকি গেটের দারোয়ানও নেই। আমি ও আমরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষায় আছি, কখন একজন এসে বলবে-আপনার অসুখ কী? কোন ডাক্তারের কাছে এসেছেন? কিন্তু হাসপাতালের লম্বা করিডোর জনমানব শূন্য।

হাসপাতালের বারান্দার পাশ ঘেঁষে একটা নারিকেল গাছ। নারিকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জোছনার আলো আসছে, জোছনার আলোকে বারান্দার নারিকেলের পাতা কাটছে চাঁদ, আর বলছে তোমাদের সংস্কৃতির আলো এভাবে আসবে, তোমার অর্থের পরিমাণ এভাবেই কাটবে।

এই অর্থ নিয়ে তোমরা কিছুই করতে পারবে না তোমাদের সংস্কৃতির জন্য, সংস্কৃতি বিস্তারের জন্য এ-বরাদ্দ নয়, অনুদান মাত্র। কিন্তু সমাজজীবন সমাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে? রাজনীতি এবং সমাজনীতির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমাদের সমাজজীবন। এই

সমাজজীবনকে কখনোই অবহেলা করতে পারেনা আমাদের সংস্কৃতি।

জাতির এবং সমাজের সুখ-দুঃখ আশা আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও আনন্দ যদি সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিফলিত না হয় তবে সে সংস্কৃতি চর্চা লক্ষ্যভ্রষ্ট। আমরা কি ভুলে যাচ্ছি ক্রমশ জাতির চেতন ও অবচেতন মনে অধঃপতনের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ দুষ্টক্ষতগুলো সম্পর্কে চৈতন্য সঞ্চার করে জাতিকে যদি সংকট উত্তরণের সাধনায় উদ্দীপ্ত না করে, তবে সংস্কৃতি পথভ্রষ্ট এবং ব্যর্থ হবে।

আমরা তো শ্রমিক-শিল্পী এবং এক নতুন দর্শক সমাজ—সরল, সহজ, সাধারণ মানুষ। অর্থ ও শিক্ষা-দম্ভী উঁচু তলার সেই সবজান্তা দর্শক নই। শুভ্র, নির্মল অনুভূতি মেলে ধরা উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে পিপাসার্ত ইন্দ্রিয়ের সব দ্বার খুলে-এরা শুনতে চায় সত্য কথা, মিথ্যা নয়।

অনাড়ম্বর হোক-তবু সত্য কথা চায়। চাকচিক্যখচিত মিথ্যা নয়। আমরা জানি সংস্কৃতি একটা জাতির জনশিক্ষার মহাবিদ্যালয়, জাতির জীবনকে গড়ে তুলবার গবেষণাগার। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সংকট জর্জর পচে-যাওয়া মরণোন্মুখ সমাজব্যবস্থার বমন, একটি গলিত শবদেহের দুর্গন্ধ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে বলার কিছুই নেই। কারণ যারা সংস্কৃতির ধারক বাহক বলে বুক ফুলিয়ে চলতেন, তারা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কীসের ভয়, কার ভয়ে হারিয়ে গেল? সে সংজ্ঞা পাওয়া ভার।

মনে হচ্ছে সংস্কৃতিচর্চা একটি শ্রেণি সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আমাদের সবারই জানা-শ্রেণি সংগ্রাম সভ্যতার সেই প্রাচীন যুগ থেকে শুরু হয়েছিল। আজ সেই শ্রেণি সংগ্রাম চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে।

২০২৫ -২০২৬ সালে সংস্কৃতির জন্য সরকারিভাবে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। কত করেছে তা আপনাদের সবারই জানা। কিন্তু এটা কী বাজেট? নাকি নামমাত্র অনুদান দেওয়া হয়েছে? এই অর্থের মধ্যে সংস্কৃতি উপদেষ্টা কীভাবে বরাদ্দ করবেন তা আমাদের বোধগম্য নয়, একমাত্র তিনিই জানেন।

যদি এও বলা হয়—সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, নজরুল একাডেমিসহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে সংস্কৃতিচর্চার জন্য সরকারিভাবে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেইসব অর্থ বরাদ্দের পরে বাংলাদেশে হাজারও সংগঠন সংস্কৃতিচর্চা করে থাকে, তারা কি কিছু পরিমিত অর্থ পাবে? আমার এবং জাতির বিশ্বাস তারা কেউই এই বরাদ্দ থেকে কোনো প্রকার অর্থ পাবে না।

বর্তমানে যারা সত্যিকারের সংস্কৃতিচর্চা করে থাকে তাদের উচিত হবে নিজ দায়িত্বে সংস্কৃতির কাজ করে যাওয়া। সংগ্রাম যখন করতেই হবে—বসে থেকে আর লাভ কী? তবে এমন সংস্কৃতিচর্চা হওয়া উচিত যেখানে কোনো রাষ্ট্রের তাবেদারি থাকবে না, থাকবে শুধুমাত্র বাংলার নিজস্ব ধারায় যে সংস্কৃতিচর্চা হওয়া উচিত তাই হবে। হয়তোবা কালের যাত্রায় পথ চলতে কষ্ট হবে, কিন্তু ফিরে আসবে সত্যিকারের সংস্কৃতি চর্চা।

বাজেট দিয়ে কী হবে বলতে পারেন? যতটা দিয়েছে তার একটা অংশ চলে যাবে ভ্যাট, ট্যাক্সে। আর বরাদ্দের সময় মিটিং, প্ল্যানিং করতে যাবে কিছু অংশ অর্থ। এভাবে ভাগ হতে হতে যে অংশটুকু পৌঁছাবে তাতে হয়তো সরকারি কিছু দিবস পালনের জন্য খরচ হবে।

এই বাজেট যে শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে আমার দেশের যাত্রাশিল্পী, লোকো শিল্পীরা না খেয়ে মরে যাক তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছি কি এই মানুষগুলো খেয়ে না খেয়ে নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই বাঁচা মরার মধ্যে সুধীজন আপনারা একটু ভেবে দেখুন, রাষ্ট্রকে বলুন—সংস্কৃতি বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। অর্থের প্রয়োজন আছে, তাই বলে কি নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে?

সরকারের এমন অর্থ বাজেট বরাদ্দের ওপর এমন একজনও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব একটি কথাও বললেন না। নাকি তারা বলতে চান না। আমরা কি চাই নাটক, গান, চলচ্চিত্র বাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতি ধুঁকে ধুঁকে বন্ধ হয়ে যাক। আমাদের সবার হাতের কলম এখন কলম দানিতে। রাষ্ট্রের পরিচালকদের বলুন—সংস্কৃতি বিভাগে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি উন্নয়ন, প্রচার-প্রসার করা সম্ভব নয়।

এখন বাংলাদেশ তরুণদের মুখোমুখি, নতুন করে বাঁচতে শেখে, শেখায়, আর সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়ছে সংস্কৃতি। আমরা ভরসার জায়গা চাই, ব্যক্তি চেতনার সঙ্গে সামাজিক চেতনার বিচিত্র সংঘাতই দেশের সংস্কৃতির মূল উপজীব্য। এটা কেবল তথ্য বা ইতিহাসের প্রশ্ন নয়, সংস্কৃতির সংজ্ঞা বা প্রকৃতির মধ্যে নিহিত, অতএব আবশ্যিক শর্ত।

আমাদের কোন চাওয়া নেই তবে যে সম্ভাবনা হয়তো বাস্তব জীবনে প্রত্যায়িত করতে পারি না, শিল্পের মাধ্যমেই যা স্বীকার করতে ভরসা পাই শুধু সেইটুকুর জন্য সংস্কৃতির দ্বার সর্বক্ষেত্রে উন্মুক্ত চাই।

ড. আরিফ হায়দার ।। অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পর্কিত বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:




রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected]; [email protected]
সম্পাদক : লিটন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top