ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্ষোভ : ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির জন্য বড় ধাক্কা
প্রকাশিত:
১২ জুন ২০২৫ ১১:৪০
আপডেট:
১৩ জুন ২০২৫ ২০:৪০

এমন একটা জায়গা থেকে বিক্ষোভ শুরু হলো যেখানে শতকরা ৮২ ভাগ মানুষ ল্যাটিন আমেরিকার হিস্পানিক অভিবাসী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি ঘোষণার পর থেকেই অবৈধ অভিবাসীদের বিতারণে মাঠে নামে তার প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা।
বেশকিছু মানুষকে গ্রেপ্তার এবং নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এমন না যে এই অভিবাসন সমস্যা কেবল ট্রাম্প প্রশাসন তার এই মেয়াদে এসেই প্রকটভাবে উপলব্ধি করছে। বছরের পর বছর ধরে উন্নত জীবনের আশায় বিশ্বব্যাপী মানুষের আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই মেয়াদে এসে এক্ষেত্রে একধরনের দ্বিচারিতা বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। ভোটের আগে সব প্রার্থীর জন্যই অভিবাসী বৈধদের ভোট যখন জয়-পরাজয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য বিবেচনায় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, ভোটের পর এসে ট্রাম্পের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা ‘অভিবাসনবিরোধী’ বিষয়টার ওপর দেশের অভ্যন্তরে কতটা রাজনৈতিক ঐকমত্য আছে, এটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি ছিল।
তবে এখানে ট্রাম্প বলে কথা। তিনি চলেন অনেকটাই নিজের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের দ্বারা, যার ক্ষতিপূরণ এখন তাকে দিতে হচ্ছে। স্মরণকালের মধ্যে অন্যতম এই বিক্ষোভ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহনশীলতার বিপরীতে তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মোটেও আস্থা রাখতে পারছেন না তিনি।
ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচিত দুজন সিনেটরও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, দেশে এই মুহূর্তে এমন কোনো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে না, যার কারণে এধরনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা মোতায়েন করার প্রয়োজন রয়েছে।
আর তাই প্রথম ধাপে মোতায়েন করেছেন ন্যাশনাল গার্ডের ২ হাজার ১শ সদস্য, যা পরবর্তীতে ৪ হাজারে উন্নীত করা হয়। বিষয়টি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ট্রাম্পের উন্মাদ আচরণের প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন। এরপরও ক্ষান্ত না হয়ে তিনি নতুন করে মোতায়েন করেছেন ৭০০ মেরিন সেনা।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, অভ্যন্তরীণ কোনো দাঙ্গা বা বিক্ষোভে বা সংঘাতে এধরনের ন্যাশনাল গার্ড এবং মেরিন সেনা মোতায়েন নজিরবিহীন। আর তাই গভর্নর এটাকে ট্রাম্পের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অবৈধ এবং অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ বলে অভিহিত করে দেশের সব মানুষকে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচিত দুজন সিনেটরও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, দেশে এই মুহূর্তে এমন কোনো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে না, যার কারণে এধরনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা মোতায়েন করার প্রয়োজন রয়েছে। এর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে যে শিষ্টাচারের চর্চা রয়েছে, সেখানেও যেন সজোরে আঘাত করেছেন ট্রাম্প।
স্বশাসিত অঙ্গরাজ্যগুলোয় কেন্দ্র থেকে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের আগে অঙ্গরাজ্যগুলোর পক্ষ থেকে এধরনের কোনো চাহিদা রয়েছে কি না তা যাচাই করার আগেই তিনি স্বশাসনের জায়গায় আঘাত করেছেন। এসবকিছুই পরিস্থিতিকে অনেক বেশি উত্তপ্ত করে তুলেছে। পরিস্থিতি এখন কেবল ট্রাম্পের অভিবাসী নীতির বিপরীতে নিছক একটি ট্রাম্পবিরোধী অবস্থানের বাইরে গিয়ে রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।
ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এধরনের কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পরিস্থিতির অবনতির কারণে কয়েকদিন ধরে জনরোষকে সামাল দিতে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে লস এঞ্জেলেসের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, লস এঞ্জেলসের পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে পুরো পরিস্থিতিই এখন বুমেরাং হয়ে গেছে।
ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরে। সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, আটলান্টা, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, ওয়াশিংটন, অস্টিন, ফিলাডেলফিয়া ইত্যাদি শহরগুলো প্রতিনিয়ত বিক্ষোভের শহর হয়ে উঠেছে। টেক্সাসের গভর্নর নিশ্চিত করেছেন যে ট্রাম্পের ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে সেখানেও।
এদিকে এসবকিছু নিয়ে ট্রাম্পের মধ্যে কোনো বিকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। উপরন্তু নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন যে তিনি এধরনের সিদ্ধান্ত না নিলে লস এঞ্জেলস ধ্বংস হয়ে যেত। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরের বিরোধিতা প্রসঙ্গে তিনি কটাক্ষ করে এর জন্য তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে সমালোচনা করার জন্য সমালোচনা করেছেন।
এভাবে একের পর এক শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া এবং ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের বিস্তৃত করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিচ্ছেন তা তিনি নিজে না জানলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, তিনি এক্ষেত্রে কেবল দেশের দীর্ঘদিনের প্রথাই ভঙ্গ করছেন না, বরং আইনের মারপ্যাঁচেও পড়তে যাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরের পক্ষ থেকে এটা নিয়ে এক মামলায় ট্রাম্প সংবিধান অমান্য করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে, কেননা সংবিধানের দশম সংশোধনীতে বলা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে যেসব ক্ষেত্রে ফেডারেল সরকারের জন্য কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবেন, সেসব ক্ষেত্রে অঙ্গ রাজ্যগুলোর কর্তৃত্ব থাকবে। তাছাড়া গভর্নরের পরামর্শ ব্যতিরেকে এধরনের বাহিনী মোতায়েন করার মধ্য দিয়ে তিনি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাও নষ্ট করছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ মাসের কম সময়ের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হচ্ছে। যেভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে হুংকার দিয়ে তিনি সূচনা করেছিলেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে নিজ দেশের মানুষ এখন তার বিরুদ্ধে হুংকার দিচ্ছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, সাধারণ বা মূলধারার মার্কিনিদের সন্তুষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে বিদ্যমান অভিবাসন নীতির বাইরে তিনি অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করে সেখান থেকে বিতারণের কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে তখন ৫৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়া যায় তার দিকে।
বিষয়টি হয়তো আরও ধীরে কিংবা একটা নির্দিষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনা করা যেত। এসব না করে তিনি রীতিমত দমনমূলক নীতি অব্যাহত রাখলে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সূচনা হয় লস এঞ্জেলস থেকে। এক্ষেত্রে সামান্য ঘটনা, অর্থাৎ গ্রেপ্তারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে জনরোষকে মোকাবিলা করে শক্তি প্রয়োগ করতে যাওয়া এবং তাও আবার অঙ্গরাজ্যের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে—এধরনের পরিস্থিতি রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করেছে এবং এর সুস্পষ্ট সুযোগ নিয়েছে বৈধ এবং অবৈধ অভিবাসী সবাই।
বর্তমানে যে কায়দায় এই আন্দোলন দমনের নামে শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে একতরফাভাবে ফেডারেল অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব ফুটে ওঠার মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টি মূলধারর মার্কিনীদের ব্যাপক অংশের অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের বাইরে গিয়ে এখন ট্রাম্প বনাম ট্রাম্পবিরোধী একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ মাসের কম সময়ের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হচ্ছে। যেভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে হুংকার দিয়ে তিনি সূচনা করেছিলেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে নিজ দেশের মানুষ এখন তার বিরুদ্ধে হুংকার দিচ্ছেন। আর তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসছে, ট্রাম্প কুলিয়ে উঠতে পারবেন তো?
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: