বাজেট ২০২৫-২৬: প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে?
প্রকাশিত:
৪ জুন ২০২৫ ১১:৩৭
আপডেট:
৬ জুন ২০২৫ ১০:২৩

প্রতি বছরই বাজেট দেওয়ার আগে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা থাকে। তবে কোনো বাজেটই জনপ্রত্যাশার পুরোটা মেটাতে পারেনি। কোনো কোনো বাজেট প্রত্যাশার কিছুটা মেটায়, কোনো কোনো বছরের বাজেট মানুষকে হতাশ করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ সালের বাজেট জনপ্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে?
প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। ২০২৫ সালের বাজেটটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বাজেট। নির্বাচিত সরকারের পেশকৃত বাজেটে থাকে দেশের মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দর্শন ও লক্ষ্যের মাঝে প্রতিস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা।
নির্বাচিত সরকারের প্রতিটি বাজেটই উপযুক্ত পরিকল্পনার লক্ষ্য বাস্তবায়নে খণ্ডচিত্র থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেওয়া বাজেটে সে সুযোগ নেই। সুতরাং এ বছরের বাজেটের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে এই বাস্তবতাটি মনে রাখা দরকার।
সেই নিরিখে বলা প্রয়োজন যে, ২০২৫-২৬ সালের বাজেটের ক্ষেত্রে কোনো জনপ্রত্যাশা ছিল না যে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি পথনির্দেশনা দেবে। বরং মানুষের আলোচনার বিষয় ছিল যে, এ বাজেট উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির নানান ভঙ্গুর বিষয় ঠিক করে দিতে প্রয়াসী হবে।
জনগণ এটাও জানতো যে, দেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা, অন্তরায় ও সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের বাজেটের কাছে উচ্চাভিলাষ প্রত্যাশিত নয়। এ বাজেট একটি স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরবে। আমি মনে করি যে, মানুষের এসব প্রত্যাশা বর্তমান বাজেট পূরণ করেছে।
তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে, বর্তমান বছরের বাজেটের মনোযোগ স্বল্পমেয়াদি হলেও বাজেটের একটি সুস্পষ্ট উন্নয়ন দর্শন থাকবে এবং সে উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে জনগণ। কিন্তু বাজেটের উন্নয়ন ব্যয় কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে বাজেটে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে ততটা নয়।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে, বর্তমান বছরের বাজেটের মনোযোগ স্বল্পমেয়াদি হলেও বাজেটের একটি সুস্পষ্ট উন্নয়ন দর্শন থাকবে এবং সে উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে জনগণ।
সুতরাং এ বছরের উন্নয়ন ব্যয়ের ২৬ শতাংশ যেখানে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্মিলিত বরাদ্দ ২০ শতাংশ। সেই সঙ্গে বাজেটে শিক্ষায় উন্নয়ন বরাদ্দ ৯ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যখাতে ১৮ শতাংশ কেটে দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এখানে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ দর্শনকে কি মানব উন্নয়ন দর্শনের ওপরে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে? কোন উন্নয়ন দর্শন বর্তমান বাজেটের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে, তার সুস্পষ্ট প্রকাশ বাজেটে থাকা উচিত ছিল। সেই অস্পষ্টতা আমাদের হতাশ করেছে।
দেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় তিনটা সমস্যা অত্যন্ত প্রকট-অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি, বিনিয়োগের বিশাল ঘাটতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি কথা প্রাসঙ্গিক।
প্রথমত: বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৩.৯৭ শতাংশ, কোভিড কাল বাদ দিলে, ৩৪ বছরের মধ্যে নিম্নতম। অথচ বর্তমান বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। এ প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান বিনিয়োগ হার দশ বছরের মধ্য নিন্মতম। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও তেমন আসছে না। বিনিয়োগের শ্লথ গতি ইতিমধ্যেই কৃষি এবং সেবা খাতকে আরও সঙ্কুচিত করবে, খাতওয়ারি ও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করবে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে, বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকবে। তার অনুপস্থিতি আমাদের হতাশ করেছে।
তৃতীয়ত: আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সামান্য কিছুটা কমলেও এখনো সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৯ শতাংশের কাছাকাছি। এ বছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ। এ প্রত্যাশা নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু এ প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা খুব কম।
জনগণও মনে করে না যে, এই প্রত্যাশা অর্জিত হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা যে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৩ বছরে একটানা ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। এখনো আমাদের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য শুধুমাত্র চাহিদার বলয়ে নয়, জোগানের আঙ্গিকেও ব্যবস্থাগ্রহণ প্রয়োজন।
জোগান খাতে উৎপাদন ও লভ্যতার ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলো দূর করা, মধ্যস্বত্বভোগীসহ সরবরাহ প্রক্রিয়ার সমস্যাগুলো দূর করা এবং সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো সরিয়ে দেওয়ার জন্য যেসব ব্যবস্থাদি নেওয়া প্রয়োজন, তার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায়নি।
আমরা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মনিয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখি। প্রবৃদ্ধিচালিত কর্মনিয়োজন নাকি কর্মনিয়োজন চালিত প্রবৃদ্ধি—এই বিষয়ে একটি পথনির্দেশনা বর্তমান বাজেটে থাকা উচিত ছিল। এ ব্যাপারে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষিখাতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জাতীয় আয়ে এ খাতের অবদান কমে আসলেও এখনো বাংলাদেশের মোট কর্মনিয়োজনের ৪৪ শতাংশ কৃষি থেকে আসে। প্রত্যাশা ছিল যে, কৃষিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেবে এ বছরের বাজেট। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, অন্যান্য বছরের মতো এবারের বাজেটেও কৃষিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
শুধু যে উন্নয়ন ব্যয়ের ৫ শতাংশের কমই কৃষিতে বরাদ্দ করা হয়েছে, তাই নয়; ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের তুলনায় কৃষিতে উন্নয়ন বরাদ্দ ১৮ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বছরের বাজেটকে এমতাবস্থায় পল্লী বা দরিদ্রবান্ধব বাজেট বলা চলে না।
ইতিমধ্যেই প্রাক্কলন করা হচ্ছে যে, প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মহীন পরিবেশ বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কারণে ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্যে খাদ্য ভর্তুকি বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে এ বছরের বাজেটে।
ভর্তুকি একধরনের অনুদান। আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে এ জাতীয় ভর্তুকি বৃদ্ধির সঙ্গে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মনিয়োজনের নানান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রচেষ্টার বজায় ক্ষমতা বর্ধনের জন্য এটা অত্যন্ত উপযোগী। বারবারই বলা হয়েছে যে, সরকারকে বর্ধিত সম্পদ আহরণ করতে হবে তার ব্যয়ভার মেটাতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের ঋণ প্রদানেরও সেটা এতটা শর্ত।
সেই সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে যে সম্পদ আহরণের জন্যে অপ্রত্যক্ষ করের ওপরে নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপরে জোর দিতে হবে। এ ব্যাপারে আয়করের কথা বারবার নানান আলোচনায় উঠে আসছিল। জনপ্রত্যাশা ছিল যে, এ ব্যাপারটি ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে উঠে আসবে। বাস্তবে সেটা ঘটেনি। অথচ আয়কর বৃদ্ধি শুধুমাত্র সম্পদ আহরণের জন্যই সহায়ক নয়, অর্থনীতিতে সমতা এবং সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যও এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও বিষয়গুলো অর্থনৈতিক নয়, তবু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি বাংলাদেশের বাজেটের লক্ষ্যসমূহ, যেমন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সুশৃঙ্খলার জন্য অপরিহার্য। বাজেটে এসব বিষয়গুলোর উল্লেখ এবং আলোচনা প্রত্যাশিত। এগুলোই বাজেটের অর্থনৈতিক আঙ্গিকের প্রেক্ষিত রচনা করে।
চূড়ান্ত বিচারে, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির নিরিখে ২০২৫-২৬ সালের বাংলাদেশ বাজেটের জনমূল্যায়ন মিশ্রিত হবে বলেই ধারণা করি।
ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: