বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর। একটু টান দিলেই হাঁপিয়ে ওঠেন। তবুও থেমে যাননি মোস্তাকিন আলী (৬৫)। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে সংসার চালাতে তিনি বুক দিয়ে টানছেন তেলের ঘানি। কখনোই গরু কেনার সামর্থ্য হয়নি তার।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারি গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাকিন আলী। এলাকায় তিনি ‘তেলী’ নামে পরিচিত। প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে তার। দিনের শুরু হয় সরিষা সংগ্রহ দিয়ে। আশপাশের গ্রাম ঘুরে ৭০ টাকা কেজি দরে সরিষা কিনে আনেন। দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরে শুরু করেন ঘানি টানা। কাঠের গুঁড়ি আর ভারি পাথরের সঙ্গে বুকের জোরে চলে এই সংগ্রাম। পাশে থাকেন স্ত্রী ছকিনা বেগম।
দিনে পাঁচ কেজি সরিষা ভেঙে প্রায় সোয়া লিটার তেল ও তিন কেজির মতো খৈল পাওয়া যায়। বিকেলে বাজারে গিয়ে কেজি প্রতি ২০০ টাকায় তেল বিক্রি করেন। সব খরচ বাদে দিনে দুই থেকে আড়াইশ টাকা হাতে থাকে। এই আয় দিয়েই চলে সংসার। তবে এখন বয়সের কারণে ঘানি টানা আগের মতো আর হয় না।
সরেজমিন দেখা যায়, মোস্তাকিন আলীর বাড়ির আঙিনায় জোড়াতালি দেওয়া টিনের ছাপড়ার ভেতর রয়েছে কাঠের ঘানি। প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি ও তার স্ত্রী ঘাম ঝরিয়ে ঘানি টানেন। তাদের একমাত্র ভরসা এই ঘানি। তবে ঘরের টিনে ছিদ্র হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির সময় পানি চুইয়ে পড়ে। ভিটেমাটি ছাড়া তাদের কোনো জমি নেই।
মোস্তাকিন আলী বলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঘানি টানতাম। এখন প্রায় ৩৫ বছর ধরে এভাবে সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বয়সের কারণে শরীর আর সায় দেয় না। হাঁপিয়ে যাই। যদি কেউ একটা গরু কিনে দিত, তাহলে গরু দিয়েই ঘানি টেনে সংসার চালাতে পারতাম। গরু কেনার টাকা আমার নেই, তাই বুক দিয়েই টানতে হয়।
স্ত্রী ছকিনা বেগম বলেন, বিয়ের পর থেকে একসঙ্গে বুক দিয়ে ঘানি টানি। এখন বয়স হয়েছে, শরীর আর আগের মতো নেই। তিনবেলা ঠিকমতো খাবারও জোটে না। একটা গরু পেলে কষ্ট কিছুটা কমত।
স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, আমরা বহু বছর ধরে দেখে আসছি, তারা এভাবেই ঘানি টানেন। আমাদের এলাকায় তারা সবচেয়ে গরিব। মাঝেমধ্যে এলাকাবাসী সাহায্য করার চেষ্টা করি। তবে কেউ যদি একটা গরু দিয়ে সহায়তা করত, তাহলে তাদের উপকার হতো।
আরেক বাসিন্দা হালিম মিয়া বলেন, এ সময়ে এসে বুক দিয়ে ঘানি টানা খুবই কষ্টের। তারা দুজনই বয়স্ক, শরীরেও আর শক্তি নেই। আমি অনেক দিন ধরে দেখছি, তারা এভাবেই ঘানি টেনে সংসার চালাচ্ছেন।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রীতম সাহা বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে দ্রুতই তাদের সরকারি সুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা করব।