41524

08/27/2025 ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে প্রস্তুতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে প্রস্তুতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

২৬ আগস্ট ২০২৫ ১৬:২০

পূর্ববর্তী লাইসেন্স অনুমোদন প্রক্রিয়ার সমালোচনা কাটিয়ে উঠে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংক-এর লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই লক্ষ্যে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ডিজিটাল ব্যাংকের ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধনের সীমা ১২৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে এবার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোর মানদণ্ড আরোপের ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেখানে গুরুত্ব পাবে আবেদনকারীর আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা।

ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক সেবা খাতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও টেকসই করে দেশের সব স্থানে দরকারি আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে সম্পূর্ণ অফিসবিহীন ও অনলাইন-নির্ভর ডিজিটাল ব্যাংক অনুমোদনের পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন এক সময়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে যখন প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে।

গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) খাত ডিজিটাল লেনদেনে যেই বিপ্লব ঘটিয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংক সেই ক্যাশলেস অর্থনীতির যাত্রাকে আরও সামনে এগিয়ে নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সাধারণ ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি সঞ্চয়, ঋণ গ্রহণ, প্রবাসী আয় গ্রহণসহ সব ধরনের আর্থিক সেবা প্রাপ্তি আরও সহজ হয়ে যাবে। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো মৌলিক ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে গেছে। ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো ভৌগোলিক সীমা না থাকায় এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছেও ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে পারবে, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের জুনে ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিমালা করে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ছিল ১২৫ কোটি টাকা, যদিও প্রচলিত ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন প্রয়োজন হয় ৫০০ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায়। আর পেমেন্ট সার্ভিস পরিচালিত হবে বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেশন, ২০১৪ অনুযায়ী। যদিও এরইমধ্যে পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আইন, ২০২৪ পাস হয়েছে, তবে এই আইনের অধীন পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম এবং ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার সংক্রান্ত বিধি বা প্রবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ২০১৪ সালের রেগুলেশন অনুযায়ী পরিচালিত হবে ডিজিটাল ব্যাংক।

নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে। তবে গ্রাহককে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যাংকের কোনো শাখা বা উপশাখা থাকবে না, কেননা সব সেবাই মিলবে মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম, এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি ডিজিটাল ব্যাংককে আনতে হবে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও)।

আবেদনকারীদের মানতে হবে কঠোর মানদণ্ড

বর্তমানে, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডিজিটাল ব্যাংক গাইডলাইন‘ সংস্কারের কাজ করছে। এতে আবেদনকারীদের জন্য কঠোর যাচাই-বাছাই এবং উন্নত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত মানদণ্ড সম্পর্কিত নতুন বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

ডিজিটাল ব্যাংক, যা নিউ ব্যাংক নামেও পরিচিত, এমন এক ধরনের ব্যাংক যেখানে গ্রাহকরা একটি মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ২৪/৭ যেকোনো স্থান থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, লেনদেন করা, বিল পরিশোধ, ঋণের আবেদন, সঞ্চয় এবং অন্যান্য সকল ব্যাংকিং পরিষেবা গ্রহণ করতে পারবেন।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে একটি দৈনিককে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা শিগগিরই ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদন আহ্বান করতে যাচ্ছে। যারা আগে ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিলেন, তারাও পুনরায় আবেদন করতে পারবে।

যে কারণে নতুন লাইসেন্সিং

প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় ২০২৩ সালে ৫২টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। ওই বছরের অক্টোবরে দুটি প্রতিষ্ঠানকে লেটার অব ইন্টেন্ট (এলওআই) দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে নতুন গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর লাইসেন্সিং প্রক্রিয়াটি পুনরায় মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি ২০২৩ সালের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ পর্যালোচনার ঘোষণা দেন, যার ফলে স্থগিত হয় নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স। নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স স্থগিত সম্পর্কে তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায় নগদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, আর্থিক অনিয়ম, জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল। অপরদিকে, কড়ি ডিজিটাল ব্যাংক এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পায়নি।

এদিকে, বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপও ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব চিহ্নিত করেছিল। বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)-এর ‘বাংলাদেশ : কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়গনস্টিক’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব উদ্ভাবনকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি নতুন উদ্যোগকেও বাধাগ্রস্ত করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের অক্টোবরে, ৫২টি আবেদনকারীর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটিকে একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছিল তাদের রাজনৈতিক পরিচয়।

যে কারণে ডিজিটাল ব্যাংক বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৪ শতাধিক ডিজিটাল ব্যাংক রয়েছে। গ্রাহকপ্রিয় ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর একটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক রেভোলুট। ব্যাংকটি আন্তর্জাতিক রেমিটেন্স, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, স্টক ট্রেডিং, পেমেন্ট, মাল্টি-কারেন্সি অ্যাকাউন্ট এবং বাজেট টুলসের জন্য সুপরিচিত। আরেক ব্যাংক জার্মানভিত্তিক এনটুসিক্স যা সহজবোধ্য মোবাইল অ্যাপ, ফি-বিহীন অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ইউরোপজুড়ে সহজ ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম ডিজিটাল ব্যাংক নিউব্যাংক ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং কলাম্বিয়াতে কোটি গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে ক্রেডিট কার্ড, সেভিংস অ্যাকাউন্ট এবং ক্ষুদ্র ঋণের মতো সেবা দিয়ে, বিশেষ করে সেসব অঞ্চলে প্রথাগত ব্যাংকিং সেবা সীমিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানও ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে।

এদিকে, শাখা এবং জনবল সংক্রান্ত উচ্চ পরিচালন ব্যয়ের কারণে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশের অনেক অঞ্চলে, বিশেষ করে দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় সেবা পৌঁছে দিতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। যদিও এমএফএস খাত দেশে ডিজিটাল লেনদেনে বিপ্লব ঘটিয়েছে, কিন্তু তাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এমএফএস সরাসরি গ্রাহকের আমানত গ্রহণ বা ঋণ প্রদান করতে পারে না, ডিজিটাল ব্যাংক এই গুরুত্বপূর্ণ শূন্যতাই পূরণ করবে।

এছাড়াও, ডিজিটাল ব্যাংক ক্ষুদ্র ব্যবসায় অর্থায়নের দিকেও মনোযোগ দিতে পারে, কারণ প্রচলিত ব্যাংকগুলো প্রায়ই বড় গ্রাহকদের উপর বেশি মনোযোগ দেয়, যার ফলে অনেক সময় ছোট গ্রাহকরা পিছিয়ে পড়েন। এমএফএস-এর মতো, ডিজিটাল ব্যাংকও ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা এবং কম ব্যাংকিং সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর মৌলিক ব্যাংকিং চাহিদা পূরণের সুযোগ নিতে পারে।

পুরোপুরি চালু হলে, ডিজিটাল ব্যাংকগুলো ২৪/৭ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করবে, যা ক্যাশলেস লেনদেনকে উৎসাহিত করবে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রসার ঘটাবে। উন্নত এনক্রিপশন, মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন এবং বায়োমেট্রিক যাচাইকরণের মতো তাদের উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ডিজিটাল ব্যাংকিংকে আরও সুরক্ষিত ও স্বচ্ছ করে তুলবে, যা জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করবে।

সর্বোপরি, জনসংখ্যাগত সুবিধা, প্রযুক্তি-সচেতন তরুণ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট কভারেজ এবং একটি ক্রমবর্ধমান মোবাইল পেমেন্টের কারণে ডিজিটাল ব্যাংক সফল হওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ রয়েছে বাংলাদেশে। শুধুমাত্র একটি স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে জটিল ব্যাংকিং পরিষেবা প্রদান করে ডিজিটাল ব্যাংকগুলো একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার আওতায় আনতে পারবে, যা দেশে টেকসই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]