শেরপুরের গারো পাহাড়ে মানুষের বিচরণ বৃদ্ধি ও বনভূমি সংকুচিত হওয়ায় বন্য হাতির জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। বন ও খাদ্যের অভাবে হাতিরা আগের আবাসস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আশ্রয় নিচ্ছে, যার ফলে হাতি-মানুষের সংঘাত দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
গত ৩০ বছরে শেরপুর জেলায় এই দ্বন্দ্বে প্রাণ হারিয়েছে ৪৭টি হাতি এবং ৬৭ জন মানুষ। স্থানীয়রা বন বিভাগের কাছ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী এবং ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গারো পাহাড়ে বন্য হাতির বিচরণ রয়েছে। ১৯৯৫ সালে ভারতের মেঘালয়ের পিক পাহাড় থেকে দলছুট হয়ে ২০-২৫টি হাতির দল এই পাহাড়ে এসেছে। ভারতের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও বিএসএফের কারণে তারা তাদের মূল আবাসস্থলে ফিরে যেতে পারেনি। খাদ্যের সন্ধানে হাতিরা ধান ও কাঁঠালের মৌসুম ছাড়াও প্রায় প্রতিরাতে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ের দিকে আসে। তাদের বিচরণ এলাকা শেরপুরের শ্রীবরদী থেকে ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী হয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার বিস্তৃত।
খাদ্য সংকটের কারণে পাহাড়ি হাতিরা প্রায়শ লোকালয়ের বাড়ি ও ফসলি জমি আক্রান্ত করে। এসময় পাহাড়িরা ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) মশাল জ্বালিয়ে, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি করে হাতি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে ভারত সীমান্ত সড়কের কালভার্টের নিচ দিয়ে হাতির দল সীমান্তের ওপারে চলে যায়, তারপর কিছুদিন পর আবার গারো পাহাড়ে ফিরে আসে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে শেরপুর জেলায় ১১ বছরে ৩৯টি হাতি ও ৩৬ জন মানুষ মারা গেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৭টি হাতি ও ৬৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানীয়দের দাবি, সরকারের উদ্যোগ থাকলেও দ্বন্দ্ব কমানোতে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
২০১৪ সালে বন বিভাগ সীমান্ত এলাকায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সৌর বিদ্যুতের বেড়া (বায়োলোজিক্যাল ফেন্সিং) নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় হাতির বিচরণ ও আক্রমণের সম্ভাব্য পথগুলিতে বেড়া নির্মাণ করা হয়। ২০১৫ সালে ঝিনাইগাতির তাওয়াকুচি ও কর্নঝুড়া এলাকায় ১০০ হেক্টর বনভূমিতে হাতির খাদ্য উপযোগী বাগান তৈরি করা হয়। তাওয়াকুচি, ছোট গজনী, বড় গজনী, হালচাটি ও মায়াঘাসি এলাকায় ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লেবু ও বেতকাটার বাগান লাগানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় ১৬টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মিত হয়েছে। এছাড়া হাতি তাড়ানোর জন্য পাহাড়ি গ্রামে চার্জার লাইট, টর্চলাইট ও জেনারেটর বিতরণ করা হলেও, বন্যহাতির ক্ষুধার কাছে এসব ব্যবস্থা প্রায় সব সময় ব্যর্থ হচ্ছে।
সম্প্রতি নালিতাবাড়ী উপজেলায় হাতির বিচরণকেন্দ্র পরিদর্শনকালে বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গারো পাহাড়ে হাতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হাতির জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হবে। পর্যাপ্ত বনভূমি নিশ্চিত করতে দখলকৃত বন উদ্ধার ও হাতির উপযোগী বনায়ন করা হবে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, মানুষের অবাধ বিচরণ ও বৃক্ষ নিধনের কারণে গারো পাহাড়ে হাতির অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। তারা মনে করেন, গারো পাহাড়ে অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা হলে এই প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে এবং হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বও কমবে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার পানিহাতা এলাকার কৃষক জোসেফ সাংমা বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে হাতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছি। প্রতি বছর ফসল ও বাড়ি-ঘর হাতির তাণ্ডবে ধ্বংস হয়।
গারো পাহাড়, বন্যপ্রাণি ও নদী রক্ষা পরিষদের উপদেষ্টা বিপ্লব দে কেটু বলেন, হাতি প্রকৃতির পাহারাদার। আমরা চাই হাতি ও মানুষের সহাবস্থান হোক। এজন্য সরকারের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ ড. আলী রেজা খান বলেন, হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব কমাতে সরকারকে আরো সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। বন উজাড় ও পাহাড়ে জনবসতির কারণে হাতির খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। গারো পাহাড়ে কতটি হাতি বসবাসের উপযোগী এবং বর্তমানে হাতির সংখ্যা কত, তা জানাও জরুরি। যদি হাতির সংখ্যা ভূমির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, শেরপুরের গারো পাহাড় ৫৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে প্রায় শতাধিক হাতি বিচরণ করে। এই হাতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, মানুষের জীবন ও সম্পত্তিও রক্ষা করতে হবে। তাই হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব কমাতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ করা হবে। হাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। হাতিকে কোনো অবস্থাতেই বিরক্ত করা যাবে না।