বাংলাদেশ ব্যাংককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর পরিবর্তে এবার ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ২০২৫’ প্রণয়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। নতুন কাঠামো অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ এবং অপসারণে সংসদের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আর কোনো সরকারি আমলা থাকবেন না। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি দিয়েই গঠিত হবে একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। এই পর্ষদের সদস্যরা হবেন অর্থনীতি, ব্যাংকিং, হিসাবরক্ষণ, বাণিজ্য, শিল্প ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা অথবা আইন বিষয়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। গভর্নরের প্রস্তাবিত তালিকা থেকেই সরকার পরিচালকদের নিয়োগ দেবে।
গভর্নরের পদমর্যাদা বাড়িয়ে মন্ত্রীর সমমর্যাদায় উন্নীত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে খসড়ায়। বর্তমানে এই পদ ১৪ নম্বর শ্রেণিভুক্ত, যা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের নিচে। খসড়া অনুযায়ী, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর উভয়েই ছয় বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন এবং একবার পুনর্নিয়োগযোগ্য হবেন। নিয়োগের আগে তাদের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে শপথ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, স্বায়ত্তশাসনের অভাবেই ব্যাংক খাতে বড় ধরনের জালিয়াতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে দ্বৈতশাসন নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা চলছে। নতুন আইন কার্যকর হলে সব ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির একক কর্তৃত্ব থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে সরকারের একটি বিভাগের মতো পরিচালিত হচ্ছে। ব্যাংকটি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হতে হলে কেবল সাংবিধানিক মর্যাদা দিলেই হবে না, গভর্নর নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকে বাছাই করতে হবে এবং গভর্নর নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর হাতে একক ক্ষমতা না রেখে সংসদীয় অনুমোদন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
নতুন কাঠামো অনুযায়ী, গভর্নর হবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এমন অনেক বিষয়ে তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, যেগুলো পরিচালনা পর্ষদের আলোচনার আওতায় নয়। গভর্নরকে সহায়তার জন্য থাকবে একটি নির্বাহী উপদেষ্টা কমিটি। কমিটিতে থাকবেন ডেপুটি গভর্নর ও সিনিয়র নির্বাহী পরিচালকরা। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে শুধু গভর্নরের হাতে।
মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার সমন্বয়ের জন্য গঠিত হবে একটি ‘সমন্বয় পরিষদ’। এর চেয়ারম্যান থাকবেন অর্থমন্ত্রী। সদস্য হিসেবে থাকবেন গভর্নর, বাণিজ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সদস্য সচিব হিসেবে অর্থ বিভাগের সচিব। এ পরিষদ বাজেট প্রণয়নের আগে অর্থনীতির সামষ্টিক দিকগুলো মূল্যায়ন করে সরকারের ঋণ ও ব্যয় পরিকল্পনা নির্ধারণে সহায়তা করবে।
নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক পাবে বাধ্যতামূলক ব্যাংক রেজোল্যুশন সংক্রান্ত ক্ষমতা। এর আওতায় একটি বিশেষ বিভাগ গঠন করে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলোর আগাম চিহ্নিতকরণ ও দ্রুত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য মূলধন ঘাটতি বা প্রশাসনিক দুর্বলতা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সরকারের লক্ষ্য, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নতুন আইন বা অধ্যাদেশ জারি করে এই কাঠামো বাস্তবায়ন শুরু করা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা সাকের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
এসএন /সীমা