বিবিসির প্রতিবেদন
শেখ হাসিনার পতনে আনন্দের বন্যা থাকলেও সামনে রয়েছে কঠিন পথ
প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০২৫ ১৩:৫৪
আপডেট:
১০ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৫৫

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানো এক বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ৫ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। তারা বিজয় উল্লাসের পাশাপাশি নতুন এক দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার’ পরিকল্পনা উন্মেচন করেন। খবর বিবিসির।
এছাড়া পুরো দেশজুড়ে এদিন বিজয় র্যালি, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, কনসার্টের আয়োজন এবং বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে অনেকে হাসিনার পতনের দিনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এই বিজয় উল্লাস গত ১২ মাসের পুরো গল্প তুলে ধরতে পারেনি।
মানব অধিকারকর্মীদের দাবি, হাসিনার পতনের পর মব সহিংসতা, গণপিটুনি, পালটা হামলা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থান ঘটেছে। যা দেশকে গণতন্ত্রের পথে চালিত করতে হুমকি তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং দেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। পাশাপাশি তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের মানুষের ওপর দমনপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এছাড়া তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে দেশে ফেরত আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
নারী অধিকারকর্মী শিরিন হক বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা একটি শাসন পরিবর্তন দেখেছি, বিপ্লব নয়। কারণ নারীবিদ্বেষ এখনো অটুট রয়েছে এবং পুরুষের আধিপত্য বিদ্যমান রয়েছে।’
এ বছরের এপ্রিলে ১০ সদস্যের এই সংস্থা তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। যেখানে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়— বিশেষ করে নারীর উত্তরাধিকার ও তালাকের অধিকার বিষয়ে। এছাড়া প্রতিবেদনে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষার দাবি জানানো হয়। কারণ যৌনকর্মীরা প্রায়ই পুলিশ ও অন্যদের দ্বারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই পরের মাসে হাজার হাজার ইসলাম সচেতন ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের দাবি ছিল, প্রস্তাবগুলো ইসলাম বিরোধী এবং নারী ও পুরুষ কখনো সমান হতে পারে না। বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বে ছিল হেফাজতে ইসলাম। তাদের একজন প্রতিনিধি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন। তিনিও নারী কমিশন বিলুপ্ত করা এবং এসব প্রস্তাব দেওয়ার জন্য এর সদস্যদের শাস্তির দাবি জানান।
পরবর্তীতে কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ্যে কোনো বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়নি। শিরিন হক বলেন, হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে অনেক অপমানের শিকার হওয়ার সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের যথেষ্ট সমর্থন দেয়নি—এটি আমাকে হতাশ করেছে। তবে ইউনুসের কার্যালয় এ অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, হাসিনার আমলে এসব কট্টরপন্থিদের একটি অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এখন আবার তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে।
শুধু তাই নয়, তারা দেশের অনেক এলাকায় নারীদের ফুটবল খেলারও বিরোধীতা করেছে। এছাড়া নারী সেলিব্রেটির মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রচারেরও বিরোধীতা করেছে এবং প্রকাশ্যে নারীরা কী ধরনের পোশাক পড়বেন, তা নিয়েও তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।
তবে শুধু নারীরাই এর খেসারত দেয়নি। গত এক বছরে কট্টরপন্থিরা সুফি মুসলমানদের মতো সংখ্যালঘুদের অসংখ্য মাজারও ভাঙচুর করেছে।
শিরিন হক বলেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ ভবিষ্যতের আশা করলেও, বাংলাদেশ এখনো আগের অবস্থানেই রয়েছে।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বেআইনি হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম এবং ভিন্নমত দমনের নৃশংস অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক জনঅসন্তোষ তৈরি হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করা সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন যারা শুধু জবাবদিহিই নয়, প্রতিশোধ ও প্রতিকারও দেখতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলে যে অবিচারগুলো ছিল, সেগুলো বর্তমান সময়েও দেখা যাচ্ছে। যেটি কোনো ভাবেই কাম্য নয়।’
আওয়ামী লীগের সমর্থক অনেক সাংবাদিক ও কর্মী হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে মাসের পর মাস জেল খাটছেন। তাদের জামিনও মঞ্জুর করছে না আদালত।
সমালোচকরা বলছেন, হত্যার এসব অভিযোগের বিষয়ে সুষ্ঠু কোনো তদন্ত হয়নি। আওয়ামী লীগকে সমর্থনের কারণেই তাদের আটকে রাখা হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘একটি বড় ধরনের গণআন্দোলনের পর স্থিতিশীলতা ফিরতে সময় লাগে। আমরা একটি পরিবর্তিত সময়ের মধ্যে রয়েছি। নাহিদ ইসলাম ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নাহিদ স্বীকার করেন দেশে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থি প্রভাব নিয়ে যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, বাস্তবতা সেরকম নয়। তিনি বলেন, ‘এটি একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অংশ’ যা বহু বছর ধরে বিদ্যমান।
তবে অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে উন্নয়নের চিত্র দেখেছেন। বিশেষ করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং আশঙ্কার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতকে বাঁচিয়ে রাখা।
এছাড়া বাংলাদেশ ঋণপরিশোধের বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছে, খাদ্য দামের স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা হয়েছে। প্রবাসী আয় ও আন্তর্জাতিক ঋণের কারণে শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলানে উন্নিত হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানিও স্থির রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের মতো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বিদ্যমান থাকলেও মব সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখার জামান বলেন, ‘আমরা একটি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করেছি, কিন্তু যতক্ষণ না আমরা স্বৈরাচারী আচরণ বন্ধ করি, ততক্ষণ আমরা সত্যিই নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব না।’
বাংলাদেশ যেহেতু এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তখন আগামী ছয় খুবই কঠিন হতে পারে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত থাকলেও জনতার সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ যখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তখন আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নির্বাসিত নেতা অভিযোগ করে বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিয়ে দলের সমর্থকদের চুপ করানো হচ্ছে, যার বেশিরভাগ নেতা নির্বাসিত বা কারাগারে।
সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বিবিসিকে বলেন, আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: