কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবে পরীক্ষার মুখে ভারতের কূটনীতি
প্রকাশিত:
১৪ মে ২০২৫ ১৭:২২
আপডেট:
১৪ মে ২০২৫ ১৮:৫৮

যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়ার খুব কাছাকাছি অবস্থানে চলে গিয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলী হস্তক্ষেপ এই সংঘাতের ইতি টেনেছে। বিশ্লেষকদের মতে, কাশ্মীর নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবের পর বৈশ্বিক কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন কঠিন এক পরীক্ষার মুখে পড়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার কারণে ভারতের আত্মবিশ্বাস ও আন্তর্জাতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এমন অবস্থানের কারণে ভারত আঞ্চলিক সংকট (যেমন শ্রীলঙ্কার ভেঙে পড়া অর্থনীতি কিংবা মিয়ানমারের ভূমিকম্প পরিস্থিতি) মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমান হামলায় সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই সংঘাতে দুই দেশের অন্তত ৬৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অতি সংবেদনশীল জায়গায় স্পর্শ করেছে।
কাশ্মীর সংকটে ভারতের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন আদায়ের যে কূটনৈতিক সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ, তা অনেকটাই নির্ভর করবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর। এই ভারসাম্য কতটা সফলভাবে রক্ষা করা যায়, তার ওপরই নির্ভর করবে কাশ্মীর ইস্যুতে ভবিষ্যৎ সংঘাতের গতিপথ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতির আওতায় যে বিস্তৃত আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ভারত সম্ভবত তাতে আগ্রহী নয়। ফলে এই যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’
দুই দেশের এই যুদ্ধবিরতি কতটা ভঙ্গুর, তা বোঝা যায় গত শনিবার রাতে দুই দেশ যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে গুরুতর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে।
উত্তেজনা যখন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন ‘অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জোড়াতালি দিয়ে’ এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয় বলে মন্তব্য করেছেন কুগেলম্যান।
গত রোববার যুদ্ধবিরতির পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি এই দুই মহান দেশের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে বাণিজ্য বাড়াতে যাচ্ছি।’
ভারত কাশ্মীরকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং মনে করে, এ নিয়ে কোনো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে তৃতীয় কোনো পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে তারা এ আলোচনা চায় না। হিমালয়ঘেরা নয়নাভিরাম অঞ্চলটি আংশিকভাবে শাসন করে ভারত ও পাকিস্তান। তবে উভয় দেশই পুরো অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে থাকে।
ইতোমধ্যে কাশ্মীর নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটি যুদ্ধ ও বহু ছোট–বড় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। ভারতের দাবি, এসব হামলার পেছনে পাকিস্তান সমর্থিত বিদ্রোহীরা দায়ী। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি মন্তব্য করেন, ‘মার্কিন চাপের মুখে মাত্র তিন দিনের মধ্যে সামরিক অভিযান বন্ধ করে ভারত আসলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ টেনে নিচ্ছে কাশ্মীর বিতর্কের দিকে—সীমান্তপারের সেই সন্ত্রাসবাদের দিকে নয়, যার কারণে এই সংকটের সূচনা হয়েছিল।’
কাশ্মীর নিয়ে নিয়মিত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের পর থেকে কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্ব মূলত এই দুই প্রতিবেশী দেশকে একই ছাঁচে দেখত।
তবে আংশিকভাবে ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে, পাকিস্তান যেখানে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানের অর্থনীতি ভারতের এক-দশমাংশের কম।
কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে ট্রাম্পের প্রস্তাব এবং ভারত ও পাকিস্তানের বৃহত্তর বিরোধ নিয়ে নিরপেক্ষ স্থানে আলোচনা শুরু করতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর ঘোষণা অনেক ভারতীয়কে ক্ষুব্ধ করেছে। কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবের জন্য পাকিস্তান একাধিকবার প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানালেও ভারত এ যুদ্ধবিরতিতে তৃতীয় কোনো পক্ষের ভূমিকা স্বীকার করেনি। বরং ভারত বলেছে, এই সমঝোতা সম্পূর্ণভাবে দুই দেশের পারস্পরিক আলোচনার ফল।
বিশ্লেষকরা ও ভারতের বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলছে, কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর গত মাসে হওয়া হামলার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানে ৭ মে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ভারত তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে কি না। হামলায় ২৬ জন নিহত হন এবং ভারত এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, ইসলামাবাদ যা অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তানের গভীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে মোদি তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা দেখিয়েছিলেন। তবে হঠাৎ যুদ্ধবিরতি তাকে নিজ দেশে বিরল সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছে।
মোদি সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক সংসদ সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ভারতে এ যুদ্ধবিরতি ভালোভাবে গৃহীত হয়নি। এর আংশিক কারণ, ‘ট্রাম্প হঠাৎ কোথা থেকে এসে যেন তার রায় ঘোষণা করেছেন।’
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা ‘যুদ্ধবিরতির ঘোষণার’ ব্যাখ্যা চায়। কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কি তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার দরজা খুলে দিলাম?’
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে একাধিক উত্তেজনাপূর্ণ বিষয় রয়ে গেছে। এগুলো ভারতের দৃঢ়তার পরীক্ষা নেবে এবং হয়তো দেশটিকে কঠোর অবস্থান নিতে প্রলুব্ধ করবে।
কূটনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন, পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে সিন্ধু পানি চুক্তি। ভারত গত মাসে এই চুক্তি স্থগিত করেছে। অথচ পাকিস্তানের বহু কৃষিজমি ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পানির উৎস এটি।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সরকারের শরিক পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে একটি বিস্তৃত সংলাপের নিশ্চয়তা না পেলে পাকিস্তান কখনোই (যুদ্ধবিরতিতে) রাজি হতো না।’
কাশ্মীর নিয়ে বারবার যুদ্ধের কিনারায় গিয়ে ফেরার যে চক্র, তা ভাঙতে ব্যাপক সমঝোতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মইদ ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘কারণ, মূল সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। আর তাই প্রতি ছয় মাস, এক, দুই বা তিন বছর পরপর এ রকম কিছু একটা ঘটে। তারপর আবার পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত পরিবেশে যুদ্ধের কিনারায় ফিরে যাই আমরা।’
সূত্র: রয়টার্স।
সম্পর্কিত বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: